‘‘কী সেটা?’’
লোকটা আরেকটা বিড়ি ধরাল৷ একটু অন্যমনস্ক দেখাচ্ছিল ওকে৷ বিড়িতে একটা লম্বা টান মেরে খানিকটা আত্মমগ্ন ভাবে বলল, ‘‘সেটা বলার আগে এই কাউরীবুড়ির মন্দির নিয়ে একটু ভেঙে বলতে হয় যে!’’
পাশে একটা ভাঙাচোরা বেঞ্চি পাতা ছিল৷ সেখানে বেশ জুত করে বসলাম৷ তারপর মনের ভাব লুকিয়ে একটু হেসে পরাগকে বললাম, ‘‘এসব কথা কি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে হয় ভায়া? এসো, এখানে বসো তো৷ চা খাবে?’’ মনে হল আপনি-র বদলে তুমি বললে হয়তো ব্যাপারটা আরও সহজে ম্যানেজ করা যাবে৷
সামনে দিয়ে মস্ত বড় কেটলি হাতে এক চাওয়ালা যাচ্ছিল৷ তাকে পাকড়াও করে তিন কাপ চা কেনা হল৷ একটা বড় ভাঁড়ে চা নিয়ে শ্রীমান মংকুকুমার উলটোদিকে পড়ে থাকা একটা বড় পাথরের ওপর অধিষ্ঠিত হলেন৷
চায়ের ভাঁড়টা হাতে নিল পরাগ, দু’হাতে চেপে ধরে খানিকটা ওম নিল৷ তারপর একটা লম্বা চুমুক দিয়ে বলল, ‘‘আপনি কাউরীবুড়ির মন্দিরে গেছিলেন শুনেই আমি কেন দৌড়ে এসেছি সেটা কি বুঝতে পারছেন?’’
নেতিবাচক মাথা নাড়লাম৷ এখনও অবধি কিছুই বুঝিনি৷
‘‘এই মন্দির আমাদের, মানে দেওরিদের কাছে একটা রহস্যবিশেষ বুঝলেন? আমাদের সমাজের বাইরে কেউ এর নাম জানে না৷ দেওরিদের মধ্যেও যারা জানে তাদের সংখ্যাও এক হাতেই গোনা যায়৷ তবে তারাও এর নামই শুনেছে, কেউ দেখেনি৷ আমরা বিশ্বাস করি যে কাউরীবুড়ির থানে যে যায়, সে আর বেঁচে ফেরে না৷’’
বেঁচে না ফেরার ব্যাপারটা কালকের সেই ভদ্রমহিলাও বলছিলেন বটে৷ আর দেওরি নামে যে এখানে একটা ট্রাইব আছে সেটা আগেই জানতাম৷ কিন্তু দেওরিদের সঙ্গে এই কাউরীবুড়ির মন্দিরের কী সম্পর্ক?
চায়ের ভাঁড়ে একটা চুমুক দিয়ে বললাম, ‘‘কেসটা কী খুলে বলো তো ভায়া৷ আমি তো কিছুই বুঝছি না৷ কে এই কাউরীবুড়ি? তাঁর মন্দিরে যাওয়া নিয়ে এত বিধিনিষেধ কীসের? আর সেখানে কেউ গেলে বেঁচে ফেরে নাই বা কেন?’’
আমার দিকে আড়চোখে তাকাল পরাগ৷ এতক্ষণে ওর আত্মভোলা ভাবটা কেটে গিয়ে সেই ধূর্ত ভাবটা ফিরে আসছিল৷ মিচকে হেসে বলল, ‘‘দেখুন, এসব হচ্ছে গিয়ে আমাদের জাতের গোপন কথা৷ এসব কথা এদিক-ওদিক বলে বেড়ানো আমাদের জন্য একেবারে নিষেধ, বুঝলেন?’’
বুঝলাম৷ গাড়ি লাইনে আসছে, না বুঝে উপায় কী?
‘‘একে আপনি বাইরের লোক, তার ওপর কাউরীবুড়ির মন্দিরেও গিয়ে একটা মস্ত বড় অপরাধ করে বসে আছেন৷ তার ওপর আপনার যে কী মতিগতি সেসব কিছুই জানি না৷ আপনাকে এতসব বলাটা কি ঠিক হবে?’’
বুঝলাম, মংকু দেখে দেখে ঠিক লোককেই এনেছে আমার কাছে৷ পকেট থেকে দুটো একশো টাকার নোট বার করে লোকটার জামার বুকপকেটে গুঁজে দিলাম৷
তাতে কাজ হল৷ শ্রীমান পরাগ বসুমাতারি তাঁর শ্রীমুখনিঃসৃত বাণী বিতরণ শুরু করলেন৷
‘‘আমরা দেওরিরা হচ্ছি এই উজনি আসামের অনেক পুরোনো জনজাতি৷ দেওরি কথাটা এসেছে দেব বা দেও থেকে৷ এককালে ঈশ্বরভক্ত জাতি হিসেবে পুরো অহোমে আমাদের বিপুল খ্যাতি ছিল৷ দেবী কেশাইখাতি-র নাম শুনেছেন তো?’’
মাথা নেড়ে জানালাম যে শুনেছি তো বটেই৷ ভারতবর্ষে পূজিত সবচেয়ে ভয়ংকরী দেবীদের মধ্যে ইনি অন্যতমা৷ সুটিয়া রাজত্বের সময় নিত্য নরবলি হত দেবী কেশাইখাতি-র মন্দিরে৷ সেই থেকে দেবীর নাম কেশাইখাতি বা কেচাইখাতি৷ অর্থাৎ যে দেবী কাঁচা খান!
‘‘কাউরীবুড়ি হচ্ছেন কেশাইখাতি-র মতোই আমাদের এক অত্যন্ত ভয়ংকর দেবী৷
এঁর ব্যাপারে বিশদে বলার আগে আমাদের দেওরিদের আরেকটা ব্যাপার বলে রাখা ভালো৷ সেটা হচ্ছে যে আমাদের মধ্যে তিনটি প্রধান উপজাতি বা গোষ্ঠী আছে৷ তাদের নাম হচ্ছে দিবংগোঁয়্যা, বড়গোঁয়্যা আর তেঙাপোনিয়া৷’’
এই তিনটে নাম রিসেন্টলি কোথায় শুনেছি না? স্মৃতির মধ্যে হাতড়াতে হাতড়াতে হঠাৎ করে বিদ্যুৎচমকের মতো মনে পড়ে গেল৷ মংকুই বলেছিল বটে!
‘‘কিন্তু এককালে এই তিনটে ছাড়াও আমাদের দেওরিদের আরও একটি উপজাতি ছিল৷’’
‘‘তাই নাকি? কী নাম তাদের?’’
‘‘পাতরগোঁয়্যা৷’’
‘‘ভেরি ইন্টারেস্টিং তো৷ তা ছিল বলছ কেন?’’
‘‘কারণ এখন আর তারা নেই বলে৷’’
পৃথিবীর ইতিহাসে বিলুপ্তির অন্ধকারে হারিয়ে যাওয়া জনজাতির উদাহরণ বিরল নয়৷ ফলে তাতে বিশেষ আমল দিলাম না৷
‘‘হুম৷ তা এই পাতরগোঁয়্যা না কী একটা বললে, তাদের আজ কোনো চিহ্ন নেই কেন?’’
‘‘সে এক খুব পুরোনো গল্প৷’’ বেঞ্চিতে পা দুটো তুলে বেশ জুত করে বসল পরাগ, ‘‘আর সেটাই আপনাকে বিশদে বলার৷
আমাদের কিংবদন্তি অনুযায়ী, আজ থেকে আড়াইশো বছর আগে পাতরগোঁয়্যাদের বড়দেওরি নাকি ওদের দেবীর পুজোয় খুব বড়সড় একটা ভুল করে৷ তখন দেবী কঠিন অভিশাপ দেন যে একমাত্র বড়দেওরির পরিবার ছাড়া এই গোষ্ঠীর সবাই সবংশে নিহত হবে৷ আর বড়দেওরির বংশের সবাইকে বংশানুক্রমে অনন্তকাল ধরে দেবীর পুজো করে যেতে হবে৷’’
‘‘ইন্টারেস্টিং! কী এমন অপরাধ শুনি?’’
‘‘সেটা কেউ জানতে পারেনি৷ তবে সাংঘাতিক কিছু হবে৷ নইলে এত বড় অভিশাপ কেউ দেয়? দেবদেবীর পুজোয় ছোটখাটো কত ধরনের খুঁতই তো হয়ে থাকে৷’’
‘‘হুম৷ তা পাতরগোঁয়্যাদের সেই দেবীই কি কাউরীবুড়ি?’’
মাথা ঝুঁকিয়ে হ্যাঁ বলে পরাগ৷
‘‘হুম৷ তারপর?’’
‘‘তারপর আবার কী৷ একদিনের মধ্যে পাতরগোঁয়্যারা দেবীর রোষে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেল৷’’