কিছু বলার আগে একটা হালকা গন্ধ আমার নাকে এল, কিছু একটা পোড়ার গন্ধ৷ ভিজে কাঠ জ্বলতে থাকলে যেমন একটা ভ্যাপসা ধোঁয়ার গন্ধ ছড়িয়ে থাকে, সেরকম৷ গন্ধটা একটু অস্বস্তিকর৷ কিন্তু সেসবে আমল দিলাম না৷
বাজে কথায় সময় নষ্ট না করে সরাসরি প্রসঙ্গে এলাম, ‘‘তোমার ব্যাপারে শুনলাম৷ কাকু-কাকিমা কাল সবই বলেছেন আমাকে৷ আমি কি এ ব্যাপারে কোনোভাবে তোমাকে হেল্প করতে পারি?’’
‘‘না৷’’ সংক্ষিপ্ত এবং দৃঢ় উত্তর৷ বুঝলাম এভাবে হবে না৷ অন্য রাস্তা ধরতে হবে৷
‘‘তুমি জানো বোধহয়, আমি বহুদিন যাবৎ আয়ুর্বেদ নিয়ে চর্চা করি৷ সেই সূত্রে নানাধরনের ভেষজ ওষুধ জানা আছে আমার৷ যদি তোমার বা অনির্বাণের কোনো ইয়ে, মানে শারীরিক সমস্যা থাকে তো আমাকে সেটা নির্দ্বিধায় বলতে পারো৷ আমি এরকম অনেক কেস সলভ করেছি৷’’
‘‘না, তার দরকার নেই৷’’ মনে হল একটু বিরক্ত হয়েছে মেয়েটা৷
প্রমাদ গুনলাম৷ মনে হচ্ছে ভুল লাইনে খেলে চটিয়ে দিয়েছি মেয়েটাকে৷ পেশেন্ট যদি একবার বিগড়ে যায় তো মুশকিল৷ তাকে দিয়ে তখন আর কিছুই বলানো যাবে না৷
‘‘হুম৷ আচ্ছা, অন্য কথা বলা যাক৷ অবসর সময়ে তুমি কী করো মাধুরী?’’
‘‘গান শুনি৷ সিনেমা দেখি৷ বই পড়ি৷’’
‘‘গাইতে পারো?’’
‘‘পারি৷’’
‘‘একটা গেয়ে শোনাবে?’’
‘‘না৷’’ আবার সেই পাথুরে দেওয়াল৷
এবার সত্যিই মাথা চুলকোতে লাগলাম৷ আমি মনস্তত্ত্ববিদ নই৷ এসব ক্ষেত্রে কী করে মনের দরজা খুলে রোগীর হৃদয়ের গভীরে প্রবেশ করতে হয় সে আমার অজানা৷ এখন কী উপায়?
‘‘আপনি আয়ুর্বেদচর্চা করেন বললেন তো৷ আর কিছু পারেন?’’ আমার চিন্তাজালকে ছিন্ন করে বলে উঠল মাধুরী৷
‘‘আর কিছু বলতে?’’
‘‘হাত দেখতে বা কোষ্ঠীবিচার করতে পারেন?’’
সম্পূর্ণ অপ্রত্যাশিত প্রশ্ন৷ মাধুরী নিজে থেকেই আমার কোর্টে একটা সহজ বল ঠেলে দিয়েছে৷
‘‘পারি বই কি!’’ আগ্রহের সঙ্গে বলে উঠলাম, ‘‘প্রায় দশ বছর হল এই নিয়ে চর্চা করছি, পারব না মানে? খুব ভালোভাবেই পারি৷’’
‘‘ভবিষ্যৎ বলতে পারেন?’’
‘‘আলবাত৷ কী জানতে চাও বলো?’’
মাধুরী ডান হাতটা বাড়িয়ে দিল আমার দিকে৷ তারপর প্রাণহীন শুকনো স্বরে বলল, ‘‘দেখুন তো, আমি মরে যাব কবে৷’’
এইবার সোজা হয়ে বসে মেয়েটার দিকে চাইলাম৷ একটা দিশা দেখতে পাচ্ছি মনে হচ্ছে!
আমি হাত দেখতে পারি জেনে অনেক বয়স্ক বা প্রৌঢ় লোককে দেখেছি আমার হাতে তাঁদের হাত তুলে দিতে৷ তাঁরা খেলাচ্ছলে জিজ্ঞেস করেন, ‘‘ভালো করে দেখে বলো তো বাছা, এই ভবযন্ত্রণা থেকে মুক্তি পাব কবে?’’ বোঝাই যায় তাঁরা মরতে চাওয়ার মুহূর্তটির খোঁজ নয়, বরঞ্চ আর ক’দিন বেঁচে থাকতে পারবেন তার হিসেব চান৷ আমিও তাই প্রতিটি ক্ষেত্রে হাসিমুখে বলি, ‘‘আরে আপনি এখনও অনেকদিন বাঁচবেন মাসিমা৷ আগে নাতির ঘরে পুতির মুখ দেখুন৷ তারপর নাহয় পরপারে যাওয়ার কথা ভাববেন৷ এখনই তাড়া কীসের?’’ তাঁরাও মনোমতো উত্তর পেয়ে হাসিমুখে আশীর্বাদ করে চলে গেছেন৷
কিন্তু মাধুরীর বলার মধ্যে একটা রিক্ত আকুতি ছিল, একটা নিঃশেষ ফুরিয়ে যাওয়া ছিল, মৃত্যুর দিকে অলস বয়ে যাওয়া ছিল৷ ওর প্রতিটি স্বরে ফুটে উঠছিল এক নির্মম অমোঘ সত্য, ওপারের চিঠির খোঁজে উদগ্রীব এই মেয়ে৷ আর সেই তিক্ত উদাসীন শূন্য আকুতির সঙ্গে একটা জায়গারই তুলনা চলে৷
শ্মশান৷
কথাটা ভাবতে ভাবতেই ফের সেই গন্ধটা আমার নাকে এল৷ ভিজে কাঠ পোড়ার গন্ধ৷ ভ্যাপসা, শ্বাসরুদ্ধকর একটা গন্ধ৷
হাতটা তুলে আমার দু’হাতের মধ্যে নিলাম৷ আগেই বলেছি, এই শাস্ত্রে আমার কিছু ব্যুৎপত্তি আছে৷ হাওড়া শালকিয়ার বিখ্যাত জ্যোতিষাচার্য আশুতোষ ন্যায়রত্ন নিজের হাতে আমাকে এই শাস্ত্রে দীক্ষা দিয়েছেন৷ তাঁর শিক্ষা ব্যর্থ হতে পারে না৷
নরম হাত, আঙুলগুলি চাঁপাকলির মতো৷ নখগুলি সুন্দর ও গোলাকার আকারের৷ এ মেয়ে স্পষ্টতই বৃহস্পতির জাতিকা৷ কিন্তু সেই সঙ্গে এও লক্ষ করলাম যে সমস্ত হাত জুড়ে একটা কালো ছোপ পড়েছে৷ চামড়াগুলো শুকনো, খসখসে৷ নখের ডগাগুলো নিষ্প্রাণ এবং ফ্যাকাশে৷ দেখে মনে হল চাঁদের গায়ে যক্ষ্মার গ্রহণ লেগেছে৷
হাতের তেলোটা দেখেই চমকে উঠলাম৷ এ যে অতি উঁচু দরের আধ্যাত্মিক হাত! লাখে একটা মেলে! বৃহস্পতির স্থান অতি উচ্চ, সেখানে একটি রিং চিহ্ন বর্তমান৷ সেইসঙ্গে শনির স্থানও উচ্চ এবং সেখানে একটি ত্রিশূলচিহ্ন স্পষ্ট৷ তার ওপর কেতুর স্থান থেকে বৃহস্পতি অবধি একটি রেখা প্রসারিত৷ অত্যন্ত উচ্চকোটির ঐশী অনুগ্রহপ্রাপ্ত মানুষ না হলে এই তিনটি চিহ্ন থাকে না৷ এও বুঝতে পারছিলাম যে জাতিকার জীবনে অন্তত এমন একটি ঘটনা ঘটবে যার দ্বারা তিনি ঈশ্বরের কাছাকাছি পৌঁছোবেন! কিন্তু সেটা যে কী তা হাত দেখে বোঝা দুষ্কর৷
কিন্তু আমার চোখে ধরা পড়ে গেছিল একটা খুব অদ্ভুত জিনিস৷ জাতিকার বাইশ বছর বয়সে একটা প্রায় একইসঙ্গে মৃত্যুযোগ এবং বৈধব্যযোগ আছে৷ যদি উনি এই ফাঁড়াটা কাটিয়ে ওঠেন, তাহলে আমার গণনা আরও বলছে যে উনি কম করে আরও তিরিশ থেকে চল্লিশ বছর অবধি সুখে বাঁচবেন৷ কিন্তু যে ফাঁড়া আছে তার থেকে মুক্তি পাওয়া প্রায় অসম্ভব!
দুটো কথাই বললাম ওকে৷ শুনে খানিকক্ষণ চুপ করে রইল মাধুরী৷ তারপর মুখ তুলে বলল, ‘‘আমার ভগবান চাই না দাদা, ভগবানের আশীর্বাদও চাই না৷ এই জীবনে আমি শুধু একটা জিনিসই চাই, অনির্বাণ চৌধুরীকে ফিরে পেতে৷ ওকে ছাড়া আমার এই জীবনে আর কিছুই চাইবার নেই৷ আমার দিকে তাকিয়ে সত্যি করে বলুন তো, আমি কি ওকে আর কোনোদিনই ফিরে পাব না?’’