অস্ফুটে বলে ফেললাম, ‘‘সেইজন্যই ওই গোলকপুষ্পের কথা কেউ জানে না…!’’
পথ চলতে চলতে থমকে দাঁড়ালেন তিনি, তারপর ডান হাতের তর্জনী তুলে শাসাবার ভঙ্গিতে বললেন, ‘‘এই শেষবারের মতো আপনাকে সাবধান করে দিচ্ছি ওই ফুলের কথা ভুলেও উচ্চারণ করবেন না৷ ও ফুল মহা পবিত্র ফুল, অম্বুবাচীর দিন কাউরীবুড়ির কাছে ওকে অর্ঘ্য দেওয়া হয়৷ ওকে এখান থেকে তুলে নিয়ে যাওয়ার কথা ভুলেও ভাববেন না৷ আপনার মহাসর্বনাশ হবে৷’’
বলে থামলেন একটু৷ তারপর বললেন, ‘‘অবশ্য তুলে নিয়ে গিয়েও লাভও নেই৷ ওই মন্দির ছাড়া এই লতা আর অন্য কোথাও বাঁচবেও না৷’’
বেকুবের মতো প্রশ্ন করলাম, ‘‘কেন?’’
ভদ্রমহিলা ঘুরে দাঁড়ালেন৷
রাস্তা শেষ হয়ে আসছিল৷ যেখানে দাঁড়িয়ে ছিলাম সেখান থেকে একটু বাঁদিকে জঙ্গলের বড় রাস্তাটা দেখা যাচ্ছিল, যেটা ধরে আমি এসেছিলাম৷ সেদিকে তর্জনী তুলে আমাকে চলে যাওয়ার নির্দেশ দিলেন ভদ্রমহিলা৷ নিজে ডানদিকের একটা সুঁড়িপথ ধরে চলে যাচ্ছিলেন৷ কী একটা ভেবে থমকালেন, তারপর ঘনিয়ে আসা অন্ধকার আরও গাঢ় করে দিয়ে বললেন, ‘‘কারণ কাউরীবুড়ির কাছে দেওয়া বলির রক্ত ছাড়া ও লতা বাঁচে না৷’’
* * * *
সেদিন ফিরতে ফিরতে সন্ধে সাতটা বেজে গেছিল৷ তখন ওদিককার শহরগুলোতে ছটা বাজলেই রাত৷ তার ওপর ছিঁচকে চোর বা বিচ্ছিন্নতাবাদীদের উৎপাত তো আছেই৷ একে অচেনা জঙ্গল, তার ওপর সন্ধের অন্ধকার৷ স্রেফ একটা টর্চের ভরসায় সাপখোপের কামড় এড়িয়ে সেদিন যে কী করে ফিরেছি সে গল্প না হয় আরেকদিন বলব৷
বাড়িতে ঢোকার আগে একটু দূর থেকেই দেখতে পেলাম সদর দরজায় আলো জ্বলছে, সেখানে বেশ কয়েকজন জটলা করে৷ কাকু-কাকিমা তো আছেনই, এমনকি কাকুদের প্রতিবেশী দু-তিনজনকেও চিনতে পারলাম৷ একটু এগোতে দেখি মংকুও সেখানে উপস্থিত৷ প্রমাদ গণলাম, ব্যাটা কী বলতে কী বলেছে কে জানে?
বাড়িতে ঢুকতেই কাকু দৌড়ে এলেন, ‘‘এ কী ভবতারণ, এত রাত অবধি ছিলে কোথায়? আমি আর তোমার কাকিমা তো ভেবে ভেবে সারা৷ তার ওপর মংকু বলল আজ নাকি ওকে আসতে বারণ করে দিয়েছ? কোনো আপদ-বিপদ হয়নি তো? আমি তো আরেকটু হলেই থানায় যাচ্ছিলাম৷’’
কাষ্ঠহাসি হেসে বললাম, ‘‘আরে না না কাকু, চিন্তা করার মতো তেমন কিছুই হয়নি৷ ঘুরতে ঘুরতে একটু শহরের বাইরে চলে গেসলাম৷ তারপর গাড়ি-ঘোড়া না পেয়ে হেঁটে আসতে একটু দেরি হল, এই যা!’’
কাকিমা ছলছল চোখে বললেন, ‘‘অমন করতে আছে বাছা? পরের ছেলে বলে কি আমাদের চিন্তা হয় না? ভালোমন্দ কিছু যদি একটা ঘটে যেত?’’
আমি আমার মাকে হারিয়েছি সেই কোন ছোটবেলায়, তাঁর কথা ভালো করে মনেও পড়ে না৷ স্মৃতি বলতে একটা পুরোনো হাতে বোনা সোয়েটার আর কিছু রংচটা ফটোগ্রাফ৷ কাকিমার ছলছল চোখদুটি দেখে আমার মরে যাওয়া মায়ের কথা মনে পড়ে গেল৷ আজ যদি আমার নিজের মা বেঁচে থাকতেন, তাহলে নিশ্চয়ই তিনিও এইভাবেই আমার চিন্তায় কাতর হতেন, এইভাবেই আমার পথ চেয়ে থাকতেন?
মনস্থির গতকালই করে নিয়েছিলাম, আজ আরও দৃঢ়সংকল্প হলাম৷ এই মায়ের মুখে হাসি ফুটিয়ে তবেই আমি ফিরব৷
কুয়োতলায় দাঁড়িয়ে হাত-পা ধুয়ে নিতে নিতে মংকুকে চাপা গলায় বললাম, ‘‘খুলে বল তো, কী বলেছিস কাকুকে?’’
জল ঢালতে ঢালতে মংকু একবার ঘরের ভেতর উঁকি দিয়ে দেখে নিল৷ তারপর বলল, ‘‘বাবুকে তেমন কিছুই বলিনি৷ শুধু বলেছি দাদা আজকে আমাকে আসতে বারণ করে দিয়েছে, বলেছে শহরটা একা একা ঘুরে দেখতে চায়৷’’
‘‘সাবাস!’’ বলে গামছাটা হাতে টেনে নিলাম, ‘‘কাল সকালে তোর সঙ্গে আমার আলাদা করে কথা আছে৷’’
‘‘কী নিয়ে?’’
‘‘কাউরীবুড়ির মন্দির নিয়ে৷’’
‘‘কেন?’’ কুয়োর বালতিটা হাতে নিয়েই উঠে দাঁড়াল মংকু৷ ওর স্বরে ফের সেই ভয়ের ছায়া৷
‘‘আজ আমি কাউরীবুড়ির মন্দিরে গেছিলাম৷’’
মংকুর হাত থেকে বালতিটা সশব্দে পড়ে গিয়ে বিশ্রী একটা খ্যানখ্যানে আওয়াজ তুলল৷ আমি ধরে না ফেললে ছোকরা পড়েই যেত হয়তো৷ অতি কষ্টে ওর মুখটা চেপে ধরে আস্তে করে শুইয়ে দিলাম কুয়োতলায়৷ বাড়ির ভেতর থেকে কাকু চেঁচিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, ‘‘কী হল রে মংকু, আওয়াজ কীসের?’’ আমি চেঁচিয়ে বললাম, ‘‘ও কিছু না কাকু, বালতিটা হাত থেকে পড়ে গেসল৷’’
মুখে কিছুক্ষণ জলের ঝাপটা দিতেই পিটপিট করে চাইল ছোকরা, তারপর আমার হাত ধরে ধীরে ধীরে উঠে বসল৷ দাঁড় করাতে গিয়ে দেখি পা থরথর করে কাঁপছে ছেলেটার৷
থিতু হতে একটু সময় নিল মংকু৷ কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল, আমি ফের মুখে হাত চাপা দিয়ে বললাম, ‘‘আস্তে, এখন না৷ কাল সকাল দশটা নাগাদ করোনেশনের সামনে৷ সেখানেই কথা বলব৷ এখন বাড়ি যা৷’’
* * * *
‘‘আপনি ডেকেছিলেন?’’
ঘুরে দাঁড়াতেই দেখলাম মাধুরী৷ পরনে একটা অফ হোয়াইট শাড়ি৷ সম্পূর্ণ নিরাভরণ বেশ, হাতে শাঁখা-নোয়া কিছুই নেই, গলাও খালি৷ সদ্যবিবাহিত কোনো মেয়ের পক্ষে যেটা একটু অস্বাভাবিক৷ অলংকার বলতে শুধু ডান হাতের আঙুলে দুটো আংটি৷ তবে হ্যাঁ, সিঁথিতে ডগডগ করছে লাল টকটকে সিঁদুর৷ সধবার চিহ্ন বলতে ওইটুকুই৷
সামনের চেয়ারটা দেখিয়ে দিলাম৷ বললাম, ‘‘বোসো৷’’
ধীর পায়ে এসে চেয়ারে বসল মাধুরী৷ তারপর শান্তস্বরে বলল, ‘‘বলুন৷ ডেকেছেন কেন?’’