বড়দেওরি কথাটা কোথায় যেন শুনেছি মনে হল৷ কিন্তু তখন উত্তেজনায় মাথাটা এমন ঘেঁটে ছিল যে সেটা মাথায় এল না৷ প্রশ্ন করলাম, ‘‘সেবায়েত? মাফ করবেন, কিন্তু আজ অবধি কোনো মহিলাকে মন্দিরের সেবায়েত হতে দেখিনি৷’’
মহিলা ততক্ষণে আমার দিকে পিছন ফিরে বেতের চুপড়ি থেকে পুজোর সরঞ্জাম নামিয়ে রাখতে শুরু করেছেন৷ সেখান থেকেই বললেন, ‘‘শুনে না থাকলে শুনুন৷ সব কিছুরই তো প্রথমবার বলে কিছু হয়৷’’
পেটের মধ্যে অনেকগুলো প্রশ্নের বুজকুড়ি উঠছিল৷ একটু ইতস্তত করে প্রশ্ন করলাম, ‘‘কিন্তু আমাকে যে বলা হল এই মন্দিরে আসা নাকি লোকের বারণ৷ মানে এখানে কেউ আসে না…’’
‘‘লোকেদের বারণ করা হয়েছে বলেই তারা আসে না৷ কারণ বুড়িমা পছন্দ করেন না যে কেউ তাঁকে বিরক্ত করুক৷’’
বারণ করলেই লোকে শুনছে, শুনে ভারী আশ্চর্য লাগল৷ এখানকার লোক এত বাধ্য নাকি? ভাবতে ভাবতেই মংকুর কথা মনে পড়ে গেল৷ ও-ই বলেছিল না যে বড়দেওরির বারণ আছে এদিকে আসার?
কথাটা বলতে মহিলার ঠোঁটে একটা আলগা হাসি খেলে গেল৷ তারপর ধীর স্বরে বললেন, ‘‘ও ঠিকই বলেছে৷ ওদের বারণ আছে৷ শুধু ওরা কেন, বললাম যে, একমাত্র আমাদের পরিবারের মেয়েদের ছাড়া বাকি সবার জন্য এখানে আসা বারণ৷’’ বলে থামলেন তিনি, তারপর ব্যস্তসমস্ত হয়ে বললেন, ‘‘সরুন, সরুন৷ আমাকে পুজোটা শেষ করতে দিন’’, বলেই ব্যস্তসমস্ত পায়ে সেই দেওয়ালে গাঁথা অদ্ভুত মূর্তির সামনে গিয়ে বসলেন তিনি৷
একমাত্র এঁদের ফ্যামিলির মহিলা ছাড়া অন্য কারও পক্ষে এখানে আসা কেন বারণ সেটা আমার মাথায় ঢুকল না৷ তবে এ নিয়ে আর বেশি জানার চেষ্টা করাটা উচিত হবে বলে মনে হল না৷ চুপচাপ মাটিতে বসে ভদ্রমহিলার পুজো করা দেখতে লাগলাম৷
পুজোর পদ্ধতি বড় অদ্ভুত৷ প্রথমেই একটা বাটি থেকে রক্তচন্দন নিয়ে নিজের কপালে একটা অদ্ভুত সিম্বল আঁকলেন৷ তারপর ছোট মাটির প্রদীপে সর্ষের তেল ঢেলে তাতে সলতে দিয়ে প্রদীপ জ্বালালেন৷ একগোছা ধূপ ধরিয়ে বাঁশের তৈরি একটা ধূপদানিতে গাঁথলেন৷ সেসব সারা হলে কয়েকটা জবাফুল, পান-সুপারি, ভেজা চাল, শুকনো লংকা এসব বার করে মাটিতে রেখে পুজো শুরু করলেন৷
পুজো করতে সময় লাগল আধঘণ্টাটাক৷ অর্ঘ্যদান শেষ হতেই মন্দিরের বাইরে বেরোলেন ভদ্রমহিলা৷ অবশ্য বেশিক্ষণের জন্য না, অল্প সময় পরেই বাঁ হাতে একটা দু-পা বাঁধা পায়রা ঝুলিয়ে নিয়ে এলেন৷ ডান হাতে একটা বড়ো হাত-দা৷
এরপর ভদ্রমহিলা যেটা করলেন সেটা দেখে আতঙ্কে সিঁটিয়ে গেলাম আমি!
বাঁ হাতে পায়রাটাকে ধরে মাটিতে গাঁথা পাথরের হাড়িকাঠটার মধ্যে রাখলেন৷ তারপর সম্পূর্ণ অজানা একটা ভাষায় উচ্চৈঃস্বরে মন্ত্র বলতে বলতে হাতের দা-টা দিয়ে এককোপে পায়রাটার মুন্ডুটা কেটে ফেললেন৷ ফিনকি দিয়ে ওঠা রক্তে ভিজে গেল মহিলার শুকনো ফ্যাকাশে হাত দুটো৷ সাদা কাপড়ে ছিটকে এল রক্তের ফোঁটা৷
মুন্ডুহীন পায়রাটা কিছুক্ষণ ছটফট করে নিথর আর নিস্তেজ হয়ে গেল৷ আর পায়রাটার রক্ত গড়িয়ে গড়িয়ে পড়তে লাগল গর্তটার দিকে, যেখান থেকে উঁকি মারছে গোলকপুষ্পের লতা!
দৃশ্যটা দেখে আমার হাত-পা এমনই জমে গেছিল যে নড়তে বা কিছু বলতে পারছিলাম না৷ ইতিমধ্যেই কখন যে মহিলা হাত-টাত ধুয়ে পুজোর উপচার গুছিয়ে আমার পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন সেটা খেয়াল করিনি৷ সংবিৎ ফিরল যখন উনি আমাকে উদ্দেশ করে বললেন, ‘‘চলুন, আপনাকে জঙ্গলের বাইরে ছেড়ে দিয়ে আসি৷ আর হ্যাঁ, যা বললাম, কালই শিলিগুড়ি ফিরে যান, এদিকে আসার আর চেষ্টাও করবেন না যেন৷ কাউরীবুড়ির অনুচরেরা কিন্তু আপনাকে চিনে নিয়েছে৷ এখানে ফিরে আসার বা অন্য কোনো বদমাইশি করার বিন্দুমাত্র চেষ্টা করলে তার ফল যে ভালো হবে না, সেটা আগেই বলেই দিলাম৷’’
যে রাস্তা ধরে এসেছিলাম সেই রাস্তা ধরেই ফিরতে হল৷ এবার কোনো কাকের দেখা পেলাম না৷ ততক্ষণে বিকেল পড়ে আসছিল৷
মিনিট পনেরো হাঁটার পর ফের সেই নালার কাছে এসে পৌঁছোলাম৷ আগের বার যেখান থেকে নালাটা পেরিয়েছিলাম, ভদ্রমহিলা তার থেকে একটু দূরে হেঁটে গেলেন৷ দেখি কয়েকটা পুরোনো গাছ এপার-ওপার ফেলা আছে ব্রিজের মতো করে৷ তার মানে মহিলা এই পথেই যাতায়াত করেন৷ এদিক-ওদিক তাকাতে একটু দূরে প্রাচীন একটা ভাঙা কাঠের দেউড়িরও আভাস পেলাম৷
নালাটা পেরোতেই আস্তে আস্তে পাখিদের ঘরে ফেরার শব্দ কানে আসতে লাগল৷ হঠাৎ করে দাঁড়িয়ে পড়লাম, এতক্ষণ এসব শব্দ শুনতে পাচ্ছিলাম না কেন?
ভদ্রমহিলা আমার আগে আগে যাচ্ছিলেন৷ আমি থামতেই উনিও থেমে গেলেন৷ তারপর ঘুরে দাঁড়িয়ে প্রায় ধমকে উঠলেন, ‘‘কী হল, থামলেন কেন? চলুন৷ সন্ধে নামার আগে আপনাকে এই এলাকা ছেড়ে বেরিয়ে যেতে হবে৷ নইলে আমারও সাধ্য থাকবে না আপনাকে রক্ষা করার৷’’
‘‘শব্দ…শব্দ…’’ অস্ফুটে বললাম, ‘‘এতক্ষণ আপনার কথা ছাড়া অন্য কোনো শব্দ শুনতে পাচ্ছিলাম না কেন?’’
সন্ধে নেমে আসা আধো আঁধারের মধ্যে ভদ্রমহিলার চোখ দুটো ধক করে জ্বলে উঠল, ‘‘কারণ কাউরীবুড়ি কোনো আনন্দ বা উল্লাসের শব্দ সহ্য করতে পারেন না৷ তাই তাঁর এলাকায় সমস্ত অবাঞ্ছিত শব্দের প্রবেশ নিষেধ, কোনো অবাঞ্ছিত অতিথির প্রবেশও নিষেধ৷’’