নমস্কার করে বললাম, ‘‘আমার নাম ভবতারণ চট্টোপাধ্যায়, বাড়ি কলকাতা৷ এখন অবশ্য শিলিগুড়িতে থাকি৷ এখানে এসে উঠেছি…’’
‘‘আপনার ঠিকুজি জানতে চাইনি’’, ধমকে উঠলেন ভদ্রমহিলা, ‘‘আপনি এতদূর এলেন কী করে? আর এ জায়গার খোঁজই বা পেলেন কী করে?’’
‘‘হেঁটেই এলাম৷ উড়ে আসার তো কোনো রাস্তা নেই বলেই দেখছি৷’’ অল্প হাসার চেষ্টা করলাম৷
‘‘আপনি ঠাট্টা করছেন? আপনার স্পর্ধা তো কম নয়৷’’ দু’চোখ ধক করে জ্বলে উঠল মহিলার৷ ‘‘কে আসতে বলেছে আপনাকে? জানেন কোথায় এসেছেন আপনি?’’
‘‘জানি বই কি৷ কাউরীবুড়ির মন্দির৷ না জেনে আর আসব কেন বলুন?’’
মুহূর্তের মধ্যে মহিলার মুখের মধ্যে পরপর বিস্ময়, ভয় আর ক্রোধের ছায়া খেলে গেল৷ তারপর বললেন, ‘‘কেন এসেছেন আপনি? কী চাই এখানে?’’
আসার কারণটা বলেই ফেললাম৷ আর লুকিয়ে লাভ নেই৷
আমার কথা শুনে মহিলার কটা চোখদুটো ফের জ্বলে উঠল, দাঁতে দাঁত চিপে বললেন, ‘‘আপনার সাহস তো কম নয়! আপনি কাউরীবুড়ির ফুল তুলে নিয়ে যেতে এসেছেন? আপনি জানেন কত পবিত্র এই ফুল? সেই ফুল নিয়ে ব্যবসা করবেন? আপনার জিভ টেনে ছিঁড়ে ফেলা উচিত৷’’
ভাবলাম উলটে কটা কড়া জবাব দিই৷ তারপর ভাবলাম, থাক, এরকম পরিস্থিতে আগেও বেশ কয়েকবার পড়তে হয়েছে৷ অভিজ্ঞতায় দেখেছি যে এসব ক্ষেত্রে চুপ করে থাকাটাই বুদ্ধিমানের কাজ৷ রাস্তা যখন চিনে গেছি তখন এখানে বারবার আসা যাবে৷
চুপ করে থাকায় ফল হল৷ হিসহিসানি কমল খানিকটা, ‘‘কে রাস্তা দেখাল আপনাকে?’’
মংকুর কথাটা স্বীকার করলাম৷ এমনকি সে যে বারণ করেছিল বারবার সেটাও জানালাম৷
মহিলা খরদৃষ্টিতে কিছুক্ষণ চেয়ে রইলেন আমার দিকে৷ তারপর বললেন, ‘‘গত আড়াইশো বছর ধরে একমাত্র আমাদের পরিবারের মেয়েরা ছাড়া এই মন্দিরে আর কেউ জীবন্ত পা রাখেনি৷ রাখলেও বেঁচে ফিরে যায়নি৷ আপনি এলেন কী করে এখানে?’’
মহিলা মনে হয় উন্মাদ৷ আড়াইশো বছর ধরে ওঁদের পরিবারের মেয়েরা ছাড়া কেউ মন্দিরে পা রাখেনি? এটা বিশ্বাসযোগ্য?
এখন কথা হচ্ছে যে উন্মাদের সঙ্গে তর্কে জড়াতে নেই৷ আমি চট করে মন্দিরের গায়ে আঁকা কাউরীবুড়ির রিলিফটার দিকে একটা প্রণাম ঠুকে দিলাম, ‘‘সে একমাত্র মা কাউরীবুড়িই জানেন৷ তাঁর আশীর্বাদ ছাড়া কি এখানে আসতে পারি বলুন? মা নিজেই পথ দেখিয়ে এনেছেন আমাকে৷’’
দেখানে ভক্তিটায় বোধহয় কাজ হল৷ মহিলা সাপের চাউনিতে আমার দিকে চেয়ে বললেন, ‘‘আপনার কোনো ক্ষতি করছি না আপাতত, নিজের অজান্তে ভুল করে ফেলেছেন ভেবে ছেড়ে দিচ্ছি৷ এখন এই কোণে চুপচাপ ভদ্রভাবে বসে থাকুন৷ আমার পুজো শেষ হলে আপনাকে জঙ্গলের বাইরে ছেড়ে দিয়ে আসব৷ আর হ্যাঁ, এই যে আপনি এখানে এসেছেন, এসব কথা যেন বাইরে প্রচার না হয়৷ কালই ফিরতি ট্রেন ধরে শিলিগুড়ি ফিরে যাবেন৷ তবে কোনো প্যাঁচ কষার চেষ্টা করবেন না কিন্তু, ফের যদি দেখেছি এদিকে আসতে তাহলে কিন্তু এখান থেকে প্রাণ নিয়ে ফিরতে পারবেন না, এই বলে দিলাম৷’’
হাসতে গিয়েও নিজেকে সামলে নিলাম৷ পকেটে একটা রিভলবার, কোমরে একটা জাঙ্গল নাইফ নিয়ে ঘুরছি৷ মার্শাল আর্টও জানা আছে অল্পবিস্তর৷ তার পরেও যদি এই নিরস্ত্র মহিলা আমার প্রাণনাশের ধমকি দেন তাহলে তো…
‘‘কথাটা বিশ্বাস হল না, তাই না?’’ ভদ্রমহিলা দেখি আমার মনের কথাটা পড়ে ফেলেছেন৷ ঠোঁটের কোণ অদ্ভুতভাবে বাঁকিয়ে বললেন, ‘‘দেখবেন আমি কী করতে পারি?’’ তারপর বাইরের দিকে আঙুল তুলে নির্দেশ করলেন, ‘‘তাকিয়ে দেখুন৷’’
জঙ্গলের দিকে তাকাতেই এক ধাক্কায় আমার হৃৎপিণ্ডটা প্রায় কণ্ঠার কাছে এসে থমকে গেল৷
তাকিয়ে দেখি জঙ্গলের প্রতিটি গাছের মাথায় আর ডালে শুধু কাক আর কাক৷ এই কিছুক্ষণের মধ্যেই যেন রাজ্যের কাক হাজারে হাজারে এসে চারিদিকের সবকটা গাছের ডাল দখল করে ফেলেছে৷ এবং দখল করেছে এত নিঃশব্দে যে আমি তার আঁচ অবধি পাইনি৷ কোনো ডানা ঝাপটানোর শব্দ নেই, কোনো ডাকাডাকির শব্দ নেই৷ যেন কয়েকটা পাথরে কোঁদা মূর্তি চেয়ে আছে এদিকেই৷
না, এদিকে না৷ শুধু আমার দিকে৷ তাদের হলদেটে লাল চোখগুলো সব আমার মুখের ওপরেই স্থির হয়ে আছে হাজার জোড়া সার্চলাইটের মতো৷ সেদিকে তাকিয়ে এই প্রথম একটা জিনিস অনুভব করলাম৷ সেই নিষ্পলক জ্বলন্ত চোখগুলোতে যেটা মিশে আছে সেটাকে বলে রাগ৷ প্রবল ঘেন্না মেশানো রাগ৷ আমার মনে হল যেন প্রতিটা কাকের চোখ থেকে ঝরে পড়ছে আমাকে খুবলে খাওয়ার প্রবল বাসনা৷ কেবলমাত্র অনুমতি নেই বলে ওরা চুপচাপ বসে আসে গাছের ডালে৷ নইলে এতক্ষণে…
বলতে নেই, ওই দৃশ্য দেখে দিনের বেলাতেও বুকটা ঠান্ডা হয়ে এল৷ এসব হচ্ছেটা কী?
পেছন থেকে সেই চাপা হিসহিস শব্দটা ভেসে এল ফের, ‘‘কোনো চালাকি করার চেষ্টা করবেন না৷ তাহলে কিন্তু আপনার লাশটাও খুঁজে পাওয়া যাবে না৷ চুপচাপ ওখানে দাঁড়ান৷ আমি বার করে নিয়ে না গেলে আপনি এই জঙ্গল থেকে জ্যান্ত বেরোতে পারবেন না৷’’
‘‘কি…কি…কিন্তু আপনি কে?’’
খানিকক্ষণ চুপ করে আমার দিকে চেয়ে রইলেন মহিলা৷ মনে হল বোধহয় ভাবছেন আমাকে উত্তর দেওয়াটা ঠিক হবে কি না৷ তারপর ধীরস্বরে বললেন, ‘‘আমি এই মন্দিরের সেবায়েত, এখানকার বড়দেওরি৷’’