ঢোকার আগে একবার বাইরের দিকে তাকিয়ে নিলাম৷ গোটা চত্বরটা ঘিরে থাকা প্রতিটি গাছের ডালে অন্তত গোটা পঞ্চাশেক কাক বসে৷ কেউ ডাকছে না৷ এবং প্রত্যেকে তীক্ষ্ণ ঠোঁট উঁচিয়ে, হলদেটে লাল চোখে তাকিয়ে আছে আমার দিকে৷
কপাল ঠুকে ঢুকে পড়লাম মন্দিরের ভেতরে, যা হয় হবে৷ যার জন্য এত কষ্ট করে এত বড় ঝুঁকি নিয়েছি, সেই গোলকপুষ্প আছে কি নেই, এই মুহূর্তে সেটাই একমাত্র বিচার্য৷ বাকিটা পরে দেখা যাবে না হয়৷
আলো থেকে অন্ধকারে ঢোকার ফলেই হয়তো প্রথমে কিছু দেখতে পাচ্ছিলাম না৷ চোখটা সয়ে আসতে খানিকটা সময় নিল৷
প্রথমেই লক্ষ করলাম যে মন্দিরের মধ্যে মূর্তি বলতে কিছু নেই৷ দরজার উলটোদিকের দেওয়ালে একটা দেবীমূর্তির রিলিফ, পাথরে কুঁদে ফুটিয়ে তোলা৷ আর ঠিক তার সামনে মেঝেতে গাঁথা আছে একটা পাথরের হাড়িকাঠ৷ হাড়িকাঠের ঠিক সামনে একটা গর্ত৷ সেই গর্ত দিয়ে কী যেন একটা উঁকি দিচ্ছে৷
রুকস্যাক থেকে টর্চটা বার করে উলটোদিকের দেওয়ালে ফেললাম৷ এই কি কাউরীবুড়ির মূর্তি?
মূর্তিটা একটু অদ্ভুত৷ দেবীর কোনো বাহন নেই, পদ্মাসনে বসে আছেন৷ দেহের তুলনায় মুখটা একটু বড়, চোখদুটো আরও অস্বাভাবিক রকমের বড়৷ পাথর কুঁদে কুঁদে উড়ন্ত চুল বোঝানো হয়েছে৷ মাতৃমূর্তির মুখে সচরাচর একটা স্নিগ্ধ স্নেহচ্ছায়া লেগে থাকে৷ কিন্তু এঁর মুখে একটা তিক্ত, নিস্পৃহ, উদাসীন ভাব ফুটে আছে৷ সেই দৃষ্টিতে ভালোবাসা নেই, স্নেহ নেই, প্রেম নেই, মোহ নেই৷ কিচ্ছু নেই৷
এবার টর্চটা ঘোরালাম মেঝের দিকে৷ রিসেন্টলি কিছু পুজো-আচ্চা হয়েছে বোঝা যাচ্ছে, কারণ হাড়িকাঠের সামনে পড়ে আছে জবাফুল, আতপ চাল আর সিঁদুরলেপা অশ্বত্থের পাতা৷ আর তার সামনের গর্ত থেকে উঁকি মারছে ওটা কী?
ওদিকে আলো ফেলতেই হৃৎপিণ্ডটা একলাফে গলার কাছে উঠে এল৷ একটা লতানে গাছ বেরিয়ে আছে গর্তটা থেকে৷ পানপাতার মতো বড় বড় পাতা৷ আর তার ডগায় ফুটে আছে একটি কুঁড়ি৷ কুঁড়ির ঠিক মাথার ওপর একটি বড় পাতা সাপের ফণার মতো উঁচিয়ে আছে৷
হাতটা থরথর করে কাঁপছিল৷ এটাই যে সেই গোলকপুষ্প তাতে কোনো ভুল নেই৷ মনে মনে বর্ণনাটা একবার আউড়ে নিলাম৷ একেবারে খাপে খাপে মিলে যাচ্ছে৷ পুথিতে এও বলা আছে যে ওই কুঁড়ি ফুটতে এখনও অনেক দেরি, ফুটবে আষাঢ় মাসে, অম্বুবাচীর দিন৷ সেদিন পাতাগুলো শুকনো হয়ে ঝরে যাবে, আর ডগায় দুলবে ছাই ছাই রঙের এই আশ্চর্য ফুল৷ তার সৌরভে নাকি সমস্ত বনভূমি আমোদিত হয়ে ওঠে৷ মানুষের মনে দাউ দাউ করে জ্বলে ওঠে কামনার সহস্রশীর্ষ কালসর্প৷ সেই রাতে নাকি স্বয়ং কামদেব আর ধন্বন্তরি এই মর্তভূমিতে নেমে আসেন এই দেবভোগ্য ফুল সংগ্রহ করতে৷ তার অর্ধেক দিয়ে তৈরি হয় জীবনদায়ী ঔষধি, বাকি অর্ধেক দিয়ে উদ্দীপক কামরস!
আমি অবশ্য এতশত ভাবছিলাম না৷ আমি জানি যে সমস্ত পৌরাণিক কাহিনির পেছনে লুকিয়ে থাকে কোনো না কোনো ঐতিহাসিক বা জাগতিক সত্য৷ এইসব গল্পকথার মানে একটাই, এই ফুলের রসের কেমিক্যাল কম্পোনেন্টের দুটি বিশেষ ধর্ম আছে৷ একটি মেডিসিনাল, আরেকটি অ্যাফ্রোডিজিয়াক৷
ইতিমধ্যেই আমি আমার কর্তব্য স্থির করে নিয়েছি৷ লতাকে এখান থেকে তুলে অন্য কোথাও নিয়ে গিয়ে পরিচর্যা করে বাঁচিয়ে রাখার প্ল্যান-প্রোগ্রাম ইত্যাদি করাই আছে৷ ইতিমধ্যেই এখানকার মাটির কম্পোজিশন জোগাড় করে রেখেছি৷ এর পরে এখন একটাই কাজ বাকি, যত্ন সহকারে একে এখান থেকে তুলে একবার কালিম্পং-এ নিয়ে যাওয়ার ওয়াস্তা, ব্যস৷ আমার এক চেনা ভদ্রলোকের গ্রিন হাউস আছে কালিম্পং-এ৷ যে-কোনো লতা বা গুল্মকে বাঁচিয়ে রাখা এবং তার বংশবৃদ্ধির ব্যবস্থা করায় সেই ভদ্রলোক প্রায় ধন্বন্তরি৷ আমার আয়ুর্বেদিক গবেষণায় উনি যথেষ্ট সাহায্য করেন৷
ধীরে ধীরে রুকস্যাকটা পিঠ থেকে নামিয়ে আমার আসাহি ক্যামেরাটা বার করলাম৷ এখান থেকে লতাটাকে যথাবিহিত যত্নসহকারে উপড়ে নেওয়ার আগে তার কয়েকটা ফোটো তুলে নেওয়া আবশ্যক৷
ক্যামেরার অ্যাপার্চার ইত্যাদি ঠিক করছি, ঠিক এমন সময়ে আমার পিছন থেকে একটি তীক্ষ্ণ মহিলা কণ্ঠের চিৎকার ভেসে এল, ‘‘কে, কে ওখানে?’’
* * * *
আমি এমন চমকে উঠেছিলাম যে হাত থেকে ক্যামেরাটা পড়ে যাচ্ছিল প্রায়৷ কোনোমতে সামলেসুমলে উঠে ঘুরে দাঁড়িয়ে দেখি একজন মহিলা, ঠিক দরজার কাছটায় দাঁড়িয়ে৷ হাতে একটা বেতের চুপড়ি, দু’চোখে বিপুল বিস্ময় আর ক্রোধ৷
উঠে দাঁড়িয়ে বললাম, ‘‘এ কী! আপনি কে? কোথা থেকে এলেন?’’
মহিলা দ্রুতপায়ে এসে বেতের চুপড়িটা নামিয়ে রাখলেন৷ তারপর ঘুরে দাঁড়িয়ে ক্রুদ্ধ সর্পিণীর মতো হিসহিস করে প্রশ্ন করলেন, ‘‘কে আপনি? এখানে এলেন কী করে? কে রাস্তা দেখাল আপনাকে?’’
ভদ্রমহিলার উচ্চতা সাড়ে পাঁচ ফুট মতো৷ কটা চোখ, চওড়া চোয়াল, আর ভাঙা গাল৷ উপরের পাটির দাঁতগুলো একটু বড়৷ পরনে সাদা শাড়ি, সাদা ব্লাউজ৷ বয়েস বেশি না, পঁয়ত্রিশ থেকে চল্লিশের মধ্যেই হবে৷ কিন্তু ইতিমধ্যেই মহিলার মাথার চুল সাদা হতে শুরু করেছে৷ হিসেব মতো মহিলার এখনও যথেষ্ট যৌবনবতী থাকার কথা৷ কিন্তু তার বদলে ছড়ানো শুকনো আঙুল, কাঠ কাঠ হাত-পা এবং সারা মুখ জুড়ে রুক্ষ, শুষ্ক, বিরক্ত একটা ভাব৷ সব মিলিয়ে মহিলার উপস্থিতিটাই খুব কর্কশ ও অস্বস্তিকর৷