সে যাই হোক। একতলা বাংলো, সামনে একটা বড়ো আর একটা ছোট ঘর, পেছনেও তাই, সব মিলিয়ে এই চারটি ঘর। মেইন গেট থেকে মোরাম বিছোনো পথ হেঁটে আসার পর কয়েকধাপ সিঁড়ি, তারপর বেশ চওড়া একটা বারান্দা আর বারান্দার শেষেই সামনের দুটো ঘরের পাশাপাশি দুটো দরজা। আমরা বারান্দায় আমাদের লাগেজ নামিয়ে রেংতাকে জিগ্যেস করলাম, ‘কী গো, কোন কোন ঘরে থাকবো?’ ঝকঝকে সাদা দাঁত বার করে একগাল হেসে হিন্দি, বাংলা, সাঁওতালি মিশিয়ে সে জানালো সব ঘরই খালি আছে, আমরা যেটা খুশি সেটা নিতে পারি।
আমাদের অবশ্য পছন্দ হল পেছন দিকের ঘর দুটো। জানলা খুললেই চাপা চাপা অন্ধকারের মতো দাঁড়িয়ে আছে বিশাল অযোধ্যা পাহাড়। তার মাথার ওপর সেই ছোট্ট একফালি চাঁদ। প্রথমে ঢুকেছিলাম ছোট ঘরটায়। দীপাঞ্জন তো বিছানা দেখেই সটান শুয়ে পড়ল। বলল, ‘আমার আর শরীরে দিচ্ছে না। তোমরা ফ্রেশটেশ হয়ে নাও, তারপর ডিনারের জন্যে ডেকো।’
স্নানটান করে ফ্রেশ হতে হতে তার ন’টা বেজে গেল। এখানে জানিয়ে রাখা ভালো যে বাংলোটা ব্রিটিশ আমলে তৈরি। পুরোটাই শালকাঠের, মায় মেঝেটা অবধি। উঁচু উঁচু সিলিং, ফোর পোস্টার বেড, মেহগনি কাঠের তৈরি রাইটিং ডেস্ক, সব মিলিয়ে রাজকীয় ব্যাপার। সেই অঞ্চলে তখন সবে ইলেট্রিসিটি এসেছে। তাও সন্ধে হলেই বড় বড় লণ্ঠন বা হ্যাজাক জ্বালানোর জন্যে তৈরি থাকতে হত। ওখানে তখন সন্ধে মানেই রাত, সাতটার সময় সব শুনশান, রাস্তায় জনমনিষ্যির দেখা নেই। আমাদের অনভ্যস্ত শহুরে চোখে প্রথমে প্রথমে অদ্ভুত লাগত, পরে বুঝেছিলাম যে ওই অঞ্চলে ওটাই স্বাভাবিক।
তবে এসব অসুবিধা ভুলিয়ে দিয়েছিল পুরুলিয়ার প্রাকৃতিক দৃশ্য। দিনের পর দিন ওই অঞ্চলে ফিল্ড ওয়ার্ক করতে করতে জায়গাটার সঙ্গে আমার বেশ একটা সখ্য গড়ে উঠেছিল। দিনের বেলার রোদটা নরম মোমের মতো গায়ে লেগে থাকে। আর বিকেল নামার সঙ্গে সঙ্গে ম্যাজিকের মতো জায়গাটা বদলে যায়। মিঠে বাতাস, মহুয়াফুলের মিষ্টি গন্ধ, শাল, কেঁদ আর পলাশ বনের নয়নশোভন জঙ্গল, আর অজস্র নাম না জানা পাখিদের ওড়াউড়ি, আমার তো থাকতে থাকতে নেশাই ধরে যাচ্ছিল…’
ফের বিপদতারণ শ্রীমধুসূদন, অর্থাৎ স্যান্ডিকুমারের খকখক কাশি। পিসি এ কাশির অর্থ খুবই ভালো বোঝেন। এর মানে হচ্ছে, ‘গল্পের গাড়ি বেলাইন হচ্ছে পিসি, প্লিজ লাইনে ফিরে এসো।’ এবার আর পিসি রাগ করলেন না। একটা পানের খিলি সলজ্জভাবে মুখে পুরে বললেন, ‘সরি রে, আসলে একটু ইমোশনাল হয়ে পড়েছিলুম।
সে যাই হোক। সে রাত্রে রেংতার বানানো দুর্দান্ত ডিমের কারি আর আলুভাজা দিয়ে ভাত খেয়ে বিছানায় গা এলিয়ে দেওয়ার পর কখন যে দু’চোখের পাতা ভারী হয়ে ঘুম নেমে এল তা বুঝতেই পারলাম না!
আসল কাহিনি শুরু হল পরেরদিন থেকে।’
স্তব্ধ নিথর রাত। অযোধ্যাপাহাড়ের কোলে, একটি বড় পাথরের নীচে, কাঠকুটো দিয়ে জ্বালানো আগুন ঘিরে বসেছিলেন চারজন মানুষ। একজন পুরুষ আর তিনজন মহিলা।
চারজনের কেউই কোনও কথা বলছিলেন না। আকাশ ঢেকে আছে ঘনঘোর মেঘে। কাঠকুটো পোড়ার শব্দ ছাড়া বিশ্বচরাচরে আর কোনও শব্দ নেই।
জোর বইছে জোলো বাতাস। সেই বাতাসে শীত করার কথা। কিন্তু চারজনেই বসেছিলেন স্থির চিত্রটির মতো, যেন প্রকৃতির এই তাণ্ডবে তাঁরা সম্পূর্ণ উদাসীন। পুরুষটির বয়েস চল্লিশের আশেপাশে, গায়ে কাপড় বলতে একটি ময়লা খেটো ধুতি, ল্যাঙটের মতো করে পরা। মহিলা তিনজনের পরণে কালোপাড় সাদা শাড়ি। সেই শতচ্ছিন্ন, ময়লা, কাদা রঙের শাড়ি দেখলেই বোঝা যায় যে দারিদ্র্যের কোন নিঃসীম অতল গহ্বরে এদের বাস। সবারই চোখে বাসা বেঁধে আছে বর্তমানের বিভীষিকা আর অজানা ভবিষ্যৎ নিয়ে উদ্বেগ।
‘সিদু আর কানুর হলটা কী?’ দেশীয় ভাষায় প্রশ্ন করলেন একজন মহিলা, ‘তাদের খবর কী?’
‘কম্পানির সেপাইরা ধরে নিয়ে গেছে তাদের। গত পরশু দুপুরবেলা’, দেশীয় ভাষাতেই স্তিমিত স্বরে উত্তর দিলেন পুরুষটি, ‘উপরবান্দা গ্রামের জগমাঝি টুরিয়াচাঁদ কিস্কুর বাড়ি থেকে। দুপুরে খেতে বসেছে, এমন সময় হঠাৎ দেখে সেপাইরা ঘিরে ফেলেছে ওদের।’
‘তারপর’? তিন বৃদ্ধাই উৎকর্ণ হয়ে উঠলেন।
‘লড়েছিল বটে দুইজনে, বাঘের বাচ্চা’, সেই স্তিমিত স্বরের মধ্যেও ঝলসে ওঠে ক্রোধ, ‘কুড়াল দিয়ে দিয়েছিল পাঁচ পাঁচটা সা’জোয়ান সেপাইয়ের মুণ্ডু উড়িয়ে। আমার দুই বেটাও ছিল ওদের সঙ্গে, রূপাই আর লখাই। তারাও লড়েছিলো খুব। মরদ হয়েছে আমার ছেলেগুলো রে ডানবুড়িরা, খুব মরদ হয়েছে।’ বলতে বলতে চোখের জলে ভেসে যায় মানুষটি রুখাশুখা বুক।
‘তারপর?’
‘কেটে ফেলেছে ওদের। গলা কেটে ভাসিয়ে দিয়েছে কাঁসাইয়ের জলে। দেহগুলো ফেলে গেছিল গ্রামের জাহের থানে। সিদো, কানু, আর আমার লখাই।’ সন্তানহারা বাপের চোখে উপচে পড়ে ভরা বর্ষার যোজন জলধারা।
‘আর রূপাই?’ প্রশ্ন করেন একজন বৃদ্ধা।
‘কাঁসাই নদীতে ঝাঁপ দিয়েছিলো বেটা আমার। ভরা বর্ষার কাঁসাই, সেও বোধহয় আর বেঁচে নেই।’ চোখ মুছতে মুছতে বলেন সেই মানুষটি।
‘কী করে হয়?’ হিসহিসিয়ে ওঠেন আরেক মহিলা, ‘সারা মানভূম আর ধলভূমের মাটি যাদের আগলে রেখেছে মায়ের মতো, অযোধ্যা পাহাড়ের সবক’টা গাছের পাতায় লেখা যাদের নাম, যাদের এক চোখে বাস করে পিলচু হড়াম আর চোখে পিলচি বুড়হি, তাদের ধরে নিয়ে যায় কোন শয়তান? কী করে?’