জিওলজির ফিল্ড ওয়ার্ক টিমের বাকিরা অবশ্য তার আগেই কাজ সেরে নিয়ে কলকাতা ফিরে গেছে। ফিল্ড ওয়ার্কের সময় আমরা ছিলাম বলরামপুরে। দলে সবশুদ্ধ ছিল জনা পঁচিশেক, দুজন প্রফেসর আর তেইশজন স্টুডেন্ট। জিওলজির ফিল্ড স্টাডি যে কী টাফ সে আর কী বলব, যে না করেছে সে বুঝতে পারবে না। তবে তার আকর্ষণও অন্যরকম, মানতেই হবে। দশটা দিন যে কী করে আড্ডা গল্পগুজব আর হাসি ঠাট্টায় কেটে গেল বুঝতেই পারলাম না। কোথায় কোথায় গেছিলাম আজ আর মনে নেই, শুধু নেকরে, সিরিঙ্গি আর বেরসা এই তিনটে জায়গার নাম খুব মনে আছে।
তা ফিল্ড স্টাডি শেষ, বাকি লোকজন কলকাতা ফিরে গেছে। আমি আর মহুয়া থেকে গেলাম।
আমাদের আগেই প্ল্যান করা আউটিঙের জন্যে। বাংলোটা অবশ্য দৌড়োদৌড়ি করে দীপাঞ্জনই ঠিক করে দিয়েছিলো। এখন শুনেছি ওখানে একটা দুটো রিসর্ট টাইপ হয়েছে বটে, আমাদের সময়ে ওই ফরেস্ট বাংলোটি ছাড়া আর কিছুই ছিল না। তার ওপর সেখানেও জায়গা পাওয়া ছিল ভেরি টাফ। আমরা যে জায়গা পেয়ে গেছিলাম বেশি চেষ্টাচরিত্র না করেই তার একটা কারণ আছে, সেটা পরে বলছি। তবে সে বছর হাতির উৎপাত একটু বেশি হওয়াতে অনেকে এমনিতেই জায়গাটা এড়িয়ে চলছিলেন। সত্যি বলতে কি, সেই বছরে বাঁশিডির ফরেস্ট বাংলোতে শীতের সিজন শুরু হওয়ার মুখে আমরাই ছিলাম প্রথম ট্যুরিস্ট।’
‘অবশ্য শুধু যে আমরা দু’জন ছিলাম তা নয়, মহুয়ার ভাই দীপাঞ্জনের কথা তো আগেই বলেছি, সেও এসে আমাদের জয়েন করেছিল। ওর তখন সবে উচ্চমাধ্যমিক শেষ হয়েছে, হাতে অঢেল সময়। হেমন্তের শেষে আর শীতের শুরুতে নাকি জঙ্গলের একটা আশ্চর্য সৌন্দর্য দেখা যায়, সেইসব শুনেই ওরই পরামর্শে প্ল্যানটা বানানো। দীপাঞ্জনেরই এক ঘনিষ্ঠ বন্ধুর বাবা ফরেস্ট ডিপার্টমেন্টে ছিলেন, তাঁকে ধরেবেঁধে ওই ফরেস্ট বাংলোয় থাকার অনুমতি পাওয়া যায়। ওর সেই বন্ধুর পৈতৃক বাড়িও ছিল পুরুলিয়াতেই, মানবাজারে। ছোকরার নাম হল জোশুয়া হেমব্রম। আগে যে পিটার হেমব্রমের নাম বলেছি, সে ওই জোশুয়ার দাদা।
আগেই বলে বলেছি যে ফরেস্ট বাংলোটা যেতে হয় বাঘমুণ্ডি পুরুলিয়া রোড ধরে। মাঠাবুরুতে নেমে দশ পনেরো মিনিটের একটা হাঁটাপথ। বরাভূম স্টেশনে নেমে, ট্রেকার ধরে দীপাঞ্জন যখন বলরামপুর এসে পৌঁছল, তখনই প্রায় দুপুর তিনটে বাজে। আমরা লাঞ্চ করে রেডিই ছিলাম। দীপাঞ্জনকে লাঞ্চ করিয়ে টরিয়ে, বাজার থেকে ঝটপট করে চাল, ডাল, তেল আর আলু কিনে যখন বুধন হাঁসদা’র ভাড়া করা টেম্পোতে চেপে রওনা দিলাম, তখনই বাজে প্রায় পাঁচটা।
পৌঁছতে পৌঁছতে প্রায় সাড়ে সাতটা বেজে গেলো। তোদের মধ্যে যারা কখনও পুরুলিয়া গেছিস, তারাই জানবি যে ওখানকার শীতের সময়ে রাতের আকাশ কী চমৎকার। দিব্যি ফুরফুরে হাওয়া দিচ্ছে, মাথার ওপর সলমা জরি বসানো নীলচে কালো মখমলি আকাশ, দুপাশে শাল, পলাশ আর কেঁদ গাছের জঙ্গল, মস্ত বড় একটা অজগরের মতো শুয়ে থাকা রাস্তা, আর তার ওপর দিয়ে জন্ডিস কালারের হেড লাইট জ্বালিয়ে চলছে এক পুরোনো টেম্পো আর তাতে আমরা তিনজন বসে আছি নির্বাক হয়ে। সে এক আশ্চর্য অনুভূতি, বুঝলি?
মাঠাবুরুতে জুনিয়র হাইস্কুলের মোড়ে আমাদের নামিয়ে দিয়ে বুধনদা ফিরে গেলো। অ্যাদ্দিন ধরে আমরা বুধনদা, বুধনদা’র ছোট ভাই মংলু আর তাদের সাঙ্গোপাঙ্গদের টেম্পোতে চড়েই ফিল্ড ভিজিটে গেছি, ফলে বুধনদা’র সঙ্গে আমাদের একটা হৃদ্যতার সম্পর্ক তৈরি হয়েই গেছিল। বুধনদা আমাদের নামিয়ে দিয়ে চলে যাওয়ার আগে যেটা বলে গেল তার মর্মার্থ হচ্ছে যে, এই ফরেস্ট বাংলোর কেয়ারটেকার রেংতা কিস্কু অতি চমৎকার ছেলে, তার বাড়ি বুধনদা’র শ্বশুরবাড়ির গাঁ’য়েই। ফলে তার স্বভাবচরিত্র তথা রন্ধনকুশলতার ব্যাপারে আমরা যেন নিশ্চিন্ত থাকি। আর প্রত্যেক দুদিন অন্তর বুধন’দা নিজে এসে একবার আমাদের খবর নিয়ে যাবে।
অতি উত্তম প্রস্তাব, ফলে আমরা তিনটি মনিষ্যি হাসিমুখে বুধনদা’কে থ্যাঙ্ক ইউ ট্যাঙ্ক ইউ বলে সেই ফরেস্ট বাংলোর দিকে রওনা দিলাম।
এখনও যখন সেই ঘটনাগুলোর কথা মনের মধ্যে আসে, শুধু এইটুকু ভাবি যে সেইদিন, সেই ক্রাইসিস মোমেন্টে বুধনদা তার কথা মতো আমাদের খোঁজ করতে না এলে কিই না হতে পারত?
সে যাই হোক, আমরা তো তিনজনে সেই ভাঙা সুঁড়িপথ ধরে হাঁটা দিলুম। আকাশে কড়ে আঙুলের নখের ফালির মতো একটুখানি চাঁদ, টুকরোটাকরা হীরের কুচির মতো তারায় ভরানো একটা অসম্ভব পরিষ্কার আকাশ, চারিদিকে বুনো ফুলের মিষ্টি গন্ধ আর ঝিঁঝি পোকার ডাকের মধ্যে হাতে বড় বড় টর্চ জ্বালিয়ে যখন বাংলোর দরজায় পৌঁছলুম তখন আমার ঘড়িতে বাজে রাত আটটা।
রেংতা কিস্কু জানতোই যে আমরা আসব। ফলে আমরা যখন দেখলাম যে হাতে একটা একটা লণ্ঠন জ্বালিয়ে একটা বেঁটেখাটো কালোমতো লোক হাসিমুখে দাঁড়িয়ে আছে, তখন বিন্দুমাত্র আশ্চর্য হইনি।
রেংতা আমাদের দেখে সেলাম টেলাম ঠুকে তো একশা। লোকটার বয়েস বছর পঁয়ত্রিশ, সুঠাম চেহারা আর মুখে একটা থাউজ্যান্ড ওয়াটের স্মাইল, এই দেখেই আমাদের দিল তর হয়ে গেসলো। তার ওপর আমাদের কিনে আনা বাজারপত্তর দেখে তার খুশি আর ধরে না!