‘ওটার মানে হল সাঁওতালদের নিজের দেশ। যত মাঝি, জগমাঝি, আর পারাণিক আছে তারা সবাই শালগাছের ডাল নিয়ে গ্রামে গ্রামে ঘুরে বেড়াচ্ছে। বলছে এই দেশ, এই জঙ্গল, এই পরগনা সাঁওতালদের, ওঁরাওদের, মুণ্ডাদের, এই সম্পদে বাইরের কারও কোনও অধিকার নেই। বলছে অন্যায়ভাবে জারি করা খাজনা আর ধার নেওয়া টাকার ওপর সুদ দেবে না ওরা।’
সুদ দেবে না? জঙ্গল আর জমিন ওদের? মানে খাজনাও দেবে না? এইবার সোজা হয়ে বসলেন জেনারেল লয়েড। এসবের মানে হচ্ছে যে জমিন্দারবাবুদের হাতে টাকা আসবে না, অর্থাৎ জমিন্দারদের ক্ষতি। আর একথা কে না জানে যে জমিন্দারদের ক্ষতি মানে কোম্পানির ক্ষতি? তিনি কোম্পানির বেতনভুক ভৃত্য হয়ে এই কাজ হতে দিতে পারেন কি? অবশ্যই না, কিছুতেই না!
লোকটার ফিসফিসানি আরও গাঢ় হয়ে আসে, ‘কয়েকদিন পরেই পাঁচখেতিয়াতে ওদের একটা খুব বড় জমায়েত হবে সাহেব। সেখান থেকে ওরা নাকি কলকাতা যাবে দরবার করতে। হাজারে হাজারে ওরা জড়ো হচ্ছে, যে কোনওদিন আগুন জ্বলে যেতে পারে সাহেব।’
ট্রাইবালসগুলো কলকাতা অবধি যেতে পারে শুনেই জেনারেল লয়েডের শিরদাঁড়া বেয়ে একটা হিমশীতল স্রোত বয়ে গেল। লর্ড ডালহৌসি কড়া ধাঁচের মানুষ, এদিককার গন্ডগোলের আঁচ বিন্দুমাত্র ওদিকে পড়লে লয়েডের পরের পোস্টিং আফ্রিকাতে হওয়াও বিচিত্র নয়। তাছাড়া এই এলাকায় রেল লাইন পাতার কাজও চলছে, এর ওপর গভর্নর জেনারেল নিজেও কড়া নজর রেখেছেন। সে বিষয়েও যে কোনওরকম শৈথিল্য বরদাস্ত করা হবে না সেটাও উনি ভালো করেই জানেন।
এই আগুন ভালো করে জ্বলে ওঠার আগেই নেভাতে হবে, যে কোনও মূল্যে!
লোকটার সামনে ঝুঁকে এলেন তিনি, ‘হুমম। তা তুমি আমাদের জন্যে কী কী করতে পারো বাবু?’
ধূর্ত কুটিল চোখে চেয়ে রইল লোকটা, তারপর খিক করে হেসে বলল, ‘কম্পানি আমার জন্যে কী কী করতে পারে আগে সেইটে বলুন দিকি সাহেব।’
‘ওই চারটে ভাইকে ধরিয়ে দিতে পারবে?’ সোজা কথা সোজাই বলেন জেনারেল লয়েড।
‘তার বদলে?’ হিসহিস করে উঠল লোকটার স্বর।
‘প্রত্যেক ভাইয়ের জন্যে দশ হাজার রুপেয়া ইনাম। ডেড অর অ্যালাইভ, চারটেকেই চাই।’
টাকার কথা শুনে লোকটার চোখদুটো যেন ধ্বক করে উঠল, এমনটাই মনে হল লয়েডের, ‘হয়ে যাবে সাহেব। তবে ছোট দুটোকে ধরে লাভ নেই। পালের গোদা হচ্ছে বড় দুটো, ও দুটোকে ধরিয়ে দিলেই কিন্তু চল্লিশ হাজার আমার চাই সাহেব, সে ব্যবস্থা করে দিতে হবে আপনাকে।’
‘আর দে সো স্পেশ্যাল?’
‘বলছেন কি সাহেব? ওদের চেনেন আপনি? ওদের একডাকে হাজারে হাজারে সাঁওতাল এককাট্টা হচ্ছে, বুকের রক্ত দিতে রাজি হচ্ছে, বুঝতে পারছেন না ওদের শক্তি? আমি ওদের চিনি সাহেব, ছেলেদুটোর যেমন সাহস তেমন শক্তি। ওই দুইভাই যতক্ষণ বুক চিতিয়ে দাঁড়িয়ে থাকবে, জেনে রাখুন সাহেব, একটাও সাঁওতাল লড়াইয়ের ময়দান ছাড়বে না। ও দুটো সাচ্চা মরদ সাহেব, একেবারে বাঘের বাচ্চা।’
‘পারবে তো বাবু? নাকি আমাদের অন্য ব্যবস্থা দেখতে হবে?’
ফের সেই খিকখিক হাসি, ‘হরনাথ চৌধুরী মিথ্যে আশ্বাস দেয় না সাহেব। বলেছি যখন, কাজ হয়ে যাবে। তবে আমাকে কিন্তু সময় দিতে হবে সাহেব, খুব সতর্ক হয়ে এগোতে হবে। আপনি আপনার সেপাইদের জোগাড় করুন, কারণ লড়াইটা আটকানো যাবে না। আমি যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ওদের ব্যবস্থা করছি।’
উঠে পড়লেন কুশলী সমরবিশেষজ্ঞ জেনারেল লয়েড, কালই ক্যাপ্টেন শেরউইলকে ডেকে নিতে হবে। সাত নম্বর আর চল্লিশ নম্বর নেটিভ ইনফ্যান্ট্রি রেজিমেন্টকেই তলব করলে চলবে আপাতত। অনেক কাজ সামনে।
দেখাদেখি লোকটাও উঠে পড়েছিল। সেলাম ঠুকে ধীরে ধীরে বেরিয়ে যাবে, এমন সময় কী একটা মনে পড়াতে ঘুরে দাঁড়ালেন লয়েড, বললেন, ‘আরে ওই চুলু সাঁওতালের ছেলেগুলোর নামই তো বললে না বাবু। কী নাম ওদের?’
ধীরে ধীরে ঘুরে দাঁড়ালেন শাহদেও রাজবাড়ির নায়েব, ধূর্তশিরোমণি হরনাথ চৌধুরী। ঠোঁটটা সামান্য বেঁকিয়ে বললেন, ‘ছোট দুটোর নাম চাঁদ আর ভৈরব।’ তারপর একটু থেমে, যোগ করলেন, ‘ওদের দরকার নেই এখন, আপাতত বড় দুটোর নাম মনে রাখবেন সাহেব, ওদেরই আগে ধরা দরকার। ওদের নাম সিদহো আর কানো। সিদহো মুর্মু আর কানো মুর্মু।’
‘জায়গাটা ছিল ওয়েস্ট বেঙ্গল আর আজকে যেটাকে আমরা ঝাড়খণ্ড বলি,তার একদম সীমান্তে, বুঝলি?’ তিন নম্বর পানের খিলিটা মুখে পুরে ফের গল্পটা শুরু করলেন দীপুপিসি।
এতক্ষণে বিকেল হয়ে এসেছে, এক রাউন্ড চা হয়ে গেছে অলরেডি। দীপুপিসি আবার চা কফি খান না একেবারেই, পিসির মৌজ হচ্ছে ওই দুখানিয়ার হাতের পানে। সেইটে চিবোতে চিবোতে পিসির চোখ আরামে মুদে এল প্রায়, মুখেচোখে ফুটে উঠল স্বর্গীয় আভা। ততক্ষণে আমরা চা দিয়ে একরাউন্ড পেঁয়াজি মেরে দিলাম। তারপর মা এসে যখন বলল এরপর বাদামভাজা দিয়ে চালভাজা আসছে, তখন আমাদের আর পায় কে?
উল্লাসে সবাই মিলে বেশ ঘন হয়ে বসতেই পিসি শুরু করে দিলেন, ‘জায়গাটার নাম হচ্ছে বাঁশিডি। অযোধ্যা পাহাড়ের কোলে একটা ছোট্ট গঞ্জ মতো। বরাভূম স্টেশনে নেমে, পুরুলিয়া বাঘমুণ্ডি রোড ধরতে হয়। বলরামপুর টাউন পেরিয়ে ঘণ্টাদুয়েকের রাস্তা। বাঘমুণ্ডি পৌঁছবার আগে মাঠাবুরু বলে অযোধ্যা পাহাড়ের কোলে একটা গ্রাম আছে, তার কাছেই এই জায়গাটা। তার সিনিক বিউটি নাকি আচ্ছা আচ্ছা বিদেশি ট্যুরিস্ট স্পটের সঙ্গে পাল্লা দিতে পারে, এমনই জানিয়েছিলো দীপাঞ্জন, আমাদের এই আউটিং-এর আইডিয়াটা ওরই। থাকার মধ্যে একটা ব্রিটিশ আমলে বানানো ফরেস্ট বাংলো। ওইটেই ছিল আমাদের আস্তানা।