লোকটার হাসি এবার সহবতের বাঁধ ভেঙে দেয়, ‘ওখানেই তো ভুলটা করেছেন, পুরো বেঙ্গল প্রেসিডেন্সি টাকায় খাজনা দেয়। অথচ আপনারা খেয়াল করেননি যে এই সাঁওতালদের মধ্যে টাকাপয়সার ব্যাপারটাই নেই। এরা জিনিসের বদলে জিনিস কেনে। এরা টাকা পাবে কোথা থেকে সাহেব?’
কিছু বললেন না লয়েড। স্থির চোখে চেয়ে রইলেন।
একটু নীচু হয়ে ফিসফিসিয়ে বলল লোকটা, ‘কখনো ভেবেছেন সাহেব, এরা টাকা কোথা থেকে পায়?’
বক্তব্যটা আস্তে আস্তে প্রণিধান হচ্ছিল লয়েডের। তিনি কিছু বললেন না, শুধু গম্ভীর মুখে ভুরু কুঁচকে তাকিয়ে রইলেন।
লোকটার স্বরে এবার আর বেয়াদবির আভাস আটকানো গেল না, ‘এবার ভেবেচিন্তে বলুন দেখি সাহেব, এদের হাতে খাজনা দেওয়ার টাকা আসে কোথা থেকে?’ ফের সেই ধূর্ত শিয়ালের মতো হাসি, ‘আমরা দিই, আমরা। লেখাপড়া জানা ভদ্রলোকেরা।’
‘তারপর?’
খিক খিক হাসিটাকে বরদাস্ত করা অসম্ভব হয়ে পড়ে এবার, ‘তারপর? তারপর আর কি? আমরা এসেই দেখলাম যে ব্যাটাচ্ছেলেগুলো পড়াশোনা দূরে থাক, গুণতে অবধি শেখেনি! ক’পয়সায় একমণ ধান হয় সেটা অবধি জানে না!’
ব্যাপারটা এবার উপলব্ধি হল লয়েডের। তিনি স্তম্ভিত হয়ে বসে রইলেন।
‘তারপর কী সেটা জিগ্যেস করবেন না সাহেব? আপনি পারেনও বটে! বলি এইসব অসভ্য সাঁওতালের বাচ্চারা লেখাপড়া জানে নাকি যে হিসেব নিকেশে আমাদের সঙ্গে এঁটে উঠতে পারবে? তবে বলতে নেই সাহেব, এই আপনাদের দৌলতেই কিন্তু আমাদের হাতে দু’পয়সা আসছে বেশ। ব্যাটারা এক্কেবারে গোমুখ্যু, হিসেবনিকেশ কিছুই বোঝে না। এটা ওটা হাতিয়ে নিতে কোনও কষ্টই নেই।’
‘মাই গুডনেস,’ অস্ফুটে উচ্চারণ করেন লয়েড।
‘শুধু কি তাই? এই বুনোগুলো না থাকলে চাষআবাদ করবে কে এই এলাকায়, আর জঙ্গল কেটে বসতিই বা বসাবে কারা? আমরা ভদ্রলোকেরা করব নাকি ওসব? তবে শক্ত লোক বটে এরা, যেমন কড়া জান তেমনই গায়ে শক্তি, শুধু দু’বেলা দুটো খেতে দিতে হয় এই যা। ভুলিয়েভালিয়ে একবার ফাঁদে ফেলার ওয়াস্তা ব্যস। তারপর বাপ, ছেলে, তার ছেলে, এইভাবেই খাটিয়ে নিয়ে যাও, সস্তায় এমন মুনিষ আর কোত্থাও পাবেন না সাহেব, এই লিখে দিলাম।
‘বন্ডেড স্লেভস!’ স্তম্ভিত হয়ে গেলেন ব্রিগেডিয়ার লয়েড।
আবার সেই খিক খিক হাসি, ‘আপনাকে বলতে বাধা নেই সাহেব, এই আপনাদের দয়াতেই দেশ গাঁয়ে বেশ কয়েক বিঘে জমি আর পাকা একটা ভদ্রাসন বানিয়েছি। মালিক যেদিন কর্ম থেকে অব্যাহতি দেবেন, দেশে ফিরে একেবারে জমিয়ে বসবো ভাবছি।’
রাগে গা’টা রি-রি করছিল জেনারেল লয়েডের, ‘কিন্তু এরা তোমাদের বিরুদ্ধে ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে নালিশ করে না কেন?’ গম্ভীর স্বরে প্রশ্ন করলেন তিনি।
লোকটা খানিকক্ষণ অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল তাঁর দিকে, তারপর কোত্থাও কিচ্ছু নেই হো-হো করে বিপুল অট্টহাসিতে ফেটে পড়ল। চোয়াল শক্ত করে সেদিকে চেয়ে রইলেন প্রবীণ সেনাপ্রধান। তারপর বহু কষ্টে হাসি থামিয়ে চোখের জল মুছেটুছে সুস্থির হল লোকটা, ‘উফ, হাসিয়ে প্রায় মেরে ফেলছিলেন সাহেব। দোহাই, অমন রসিকতা আর করবেন না, পায়ে পড়ি আপনার। উফ, বাপ রে, আরেকটু হলে পেট ফেটে যাচ্ছিল। বলি সাহেব, আপনাদের ম্যাজিস্টর সাহেব বসেন কোথায়? আদালতটা কোথায়? হুইইই ভাগলপুর। বলি কখনও ভেবেছেন এখান থেকে অদ্দূর যাবে কী করে গুয়োর ব্যাটারা? গেলেও বা, মুনশি, পেশকার, মুনিম এসব সামলে সুমলে হাকিমের সামনের দাঁড়িয়ে মনের কথা গুছিয়ে বলবেই বা কী করে? এসব কোনওদিন ভেবে দেখেছেন সাহেব? এখন জিগ্যেস করছেন ওরা ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে যায় না কেন? উফ, কী প্রশ্নই না করলেন সাহেব। হাসতে হাসতে মরেই যাচ্ছিলাম প্রায়…’ লোকটার সেই বিশ্রী খিকখিক হাসি শেষই হতে চায় না আর!
সরু চোখে এই বেয়াদবিটা দেখছিলেন লয়েড। তাঁর ধৈর্য প্রায় শেষ সীমায় পৌঁছে গেছে তখন। দাঁতে দাঁত ঘষে নিলেন একবার, তারপর হিম শীতল কণ্ঠে জিগ্যেস করলেন, ‘এইসব বাজে কথা ছেড়ে কাজের কথায় এসো বাবু। বারুদের স্তূপে আগুনটা লাগাচ্ছে কে বা কারা সেটার ব্যাপারে কিছু বলবে?’
এইবার সাপের মতো চাউনি দিয়ে সামনে তাকাল লোকটা। অসমসাহসী জেনারেল লয়েডেরও বুকটা একবার কেঁপে উঠল সেই চাউনির সামনে। মনে হল একটা ধূর্ত গোখরো যেন সহসা ফণা তুলে দাঁড়াল তাঁর সামনে।
প্রায় সাপের মতোই হিসহিসে গলায় বলল লোকটা, ‘এই পাকুড় থেকে সাড়ে আঠাশ ক্রোশ উত্তরে ভোগনাডি বলে একটা গ্রাম আছে, তার নাম শুনেছেন সাহেব?’
এদেশে লক্ষ লক্ষ গ্রাম আছে, এই রাজমহলেই আছে কয়েকশো। সব গ্রামের নাম জানা লয়েডের পক্ষে সম্ভব নয়। তাই তিনি চুপ করে রইলেন।
‘সেই গ্রামের বাসিন্দা চুলু সাঁওতালের চার ছেলে, দুই মেয়ে। ওরা জাতে মুর্মু,স্যাঁওতালদের ঠাকুর আর বোঙাদের পুজো করাই ওদের কাজ। কয়েক মাস আগে পুরো রাজমহল এলাকায় দাবানলের মতো একটা খবরটা ছড়ায়। খবরটা এই, যে ঠাকুর নিজে এসে নাকি ওদের বড় দুই ছেলেকে দর্শন দিয়েছেন। বলেছেন এই দিকু জমিদার, ব্যবসায়ী আর মহাজনদের খেদিয়ে দিয়ে সাঁওতালদের নিজের দেশ প্রতিষ্ঠা করতে। দামিন-ই-কোহ নামটা শুনেছেন সাহেব?’
‘না’, জেনারেল লয়েডের মুখটা ক্রমেই থমথমে হয়ে উঠছিল।