আর ঠিক সেই সময়ে লোকটা সেই গায়ের রোম খাড়া করে দেওয়া গলায় ফিসফিস করে শুধু দু-বার বলল, কালিয়া মাসান, কালিয়া মাসান।
মহুয়াই থমকালো প্রথমে। কী বললে? বলে ঘাড়টা ঘুরিয়েই ও অবাক স্বরে বলল, এ কি! লোকটা গেল কোথায়? উধাও হয়ে গেল নাকি?
আমি আর দাঁড়াইনি, শক্ত করে মহুয়ার হাতটা চেপে ধরে দ্রুত হাঁটা লাগিয়েছিলাম স্টেশনের দিকে।
এখন আফশোস হয়, তখন যদি একটু সতর্ক হতাম, মহুয়াকে অত বড় বিপদের মধ্যে পড়তেই হত না কোনওদিন। অবশ্য আমারও হয়তো ভৈরবীমায়ের সঙ্গে দেখাটা কোনওদিন হত না।’
রাতের অন্ধকারে লোকটা যখন গামছাতে মাথা অবধি মুড়িয়ে ব্রিগেডিয়ার জেনারেল লয়েডের বাংলোয় এল তখন চারিদিকে অবিশ্রান্ত ধারায় বৃষ্টি পড়ছে। ব্রিগেডিয়ার লয়েড তখন ডিনার সেরে দামি মুর্শিদাবাদি সিল্কের গাউন পরে অত্যন্ত বিরক্তমুখে চুরুট খাচ্ছিলেন। ইন্ডিয়ার মনসুন কোনওদিনই ওঁর পছন্দ নয়, নেহাত ইস্ট ইন্ডিয়া কম্পানি ভালো পয়সা দিচ্ছে তাই এই গড ফরসেকেন কান্ট্রিতে থাকতে আসা। তার ওপর সারাদিন ধরে এই এক ঘ্যানঘেনে বৃষ্টিতে তাঁর মেজাজ টঙে চড়ে ছিল। নইলে কোথায় স্কটিশ হাইল্যান্ড, আর কোথায় এই রাজমহলের জঙ্গল। বিরক্তি আর রাগে গরগর করছিলেন দোর্দণ্ডপ্রতাপ সমরনায়ক জেনারেল লয়েড।
এমন সময় খাস খানসামা মুনাব্বর খাঁ এসে এত্তেলা দিল, ‘চওধরী সাব আয়ে হ্যাঁয়।’
হাত নেড়ে দর্শনপ্রার্থী লোকটিকে তাঁর খেদমতে পেশ করতে বললেন জেনারেল লয়েড, তারপর নড়েচড়ে সোজা হয়ে বসলেন।
আবহাওয়া ভালো না, একদমই ভালো না। ভাগলপুর থেকে শুরু করে বীরভূম, বস্তার থেকে রাজমহল, পুরো ছোটনাগপুর মালভূমি এলাকাটাই যেন এখন আগ্নেয়গিরির ওপর বসে আছে। এই এলাকা সাঁওতালদের এলাকা, তাদের মধ্যে বিদ্রোহের চাপা আঁচ ধিকিধিকি জ্বলতে জ্বলতে আজ ভিসুভিয়াস হয়ে ফেটে পড়ার উপক্রম। চারিদিকে বারুদের গন্ধ, বিদ্রোহের ধ্বনি। এই জঙ্গলের হাওয়ায় হাওয়ায়, পাতায় পাতায় কান পাতলে শোনা যাচ্ছে রক্তমাতাল করা সেই ডাক।
হুল। হুল জোহার।
কম্পানীর পোষা গুপ্তচরেরা এই ব্যাপারে উৎকণ্ঠিত হওয়ার মতো রিপোর্ট পাঠাচ্ছে বারবার। সেসব ব্যাপারে বিশদে খবরাখবর জানতেই আজ এই গোপন রঁদেভু’র আয়োজন।
বেঁটেখাটো চেহারার লোকটা ঘরে ঢুকেই আভূমি প্রনত হয়ে সেলাম ঠুকলো, ‘সেলাম সাহিব।’
লোকটাকে একদম পছন্দ করেন না জেনারেল লয়েড, টাকার জন্যে যারা স্বদেশবাসীর সঙ্গে বেইমানি করে তাদের পছন্দ করার কথাও না। কিন্তু লোকটা ক্ষমতাশালী, তার ওপর এই এলাকার নেটিভ সাঁওতালদের অনেক খবরাখবরও রাখে। নেহাত বাধ্য হয়েই লোকটাকে প্রশ্রয় দেন তিনি। ইচ্ছে আছে যে এইসব ঝামেলা শেষ হলে একদিন কোনও একটা ছুতোনাতায় লোকটাকে ধরে কামানের মুখে বেঁধে উড়িয়ে দেবেন তিনি। তবে ব্রিগেডিয়ার লয়েড ঝানু সমরবিদ, মনের মধ্যে ঝড় বয়ে চললেও মুখে প্রকাশ করেন না। দিব্যি সভ্যভব্য ভাবে আপ্যায়ন করলেন এই নিশিরাতের অতিথিকে। চেয়ারে বসতে ইঙ্গিত করে মধুর হাসিতে ভুবন ভরিয়ে জিগ্যেস করলেন, ‘ওয়েল বাবু, এত রাতে এসেছো যখন, কোনও ইম্পর্ট্যান্ট খবর নিয়েই এসেছো পাক্কা। কী সেই খবর বাবু? টেল মি।’
‘অবস্থা খুব খারাপ সাহেব, হাওয়া খুবই গরম। যে কোনওদিন এই সাঁওতালরা আমাদের, মানে বাঙালি জমিদার, নায়েব, মহাজন এদের ওপর চড়াও হতে পারে। এই এলাকার সব মাড়োয়াড়ি আর বাঙালি মহাজনেরা আমাকে ধরে বসেছে আপনার সঙ্গে কথা বলার জন্যে। হুজুর আমাদের মাই বাপ, কিছু তো নিশ্চয়ই করবেন।’
‘কিন্তু হঠাৎ এরা এরকম ক্ষেপে গেল কেন বাবু? কিছু তো কারণ আছেই?”সে তো আছেই সাহেব। শুধু শুধু আর মানুষে এতটা ক্ষেপে যায়? দেওয়ালে পিঠ ঠেকে গেলে তো নিরীহ বেড়াল অবধি পালটা মার দেয়। আর এরা তো মানুষ।’
‘কিন্তু দেওয়ালে পিঠ ঠেকেই বা গেল কেন?’
‘পেটে লাথ পড়লে মানুষের আর কীই বা করার থাকে সাহেব? নিজের জায়গা, জমিন, ঘরবাড়ি যদি বেদখল হয়ে যায়…’
অধৈর্য হলেন ব্রিগেডিয়ার লয়েড, ‘আহ, বড় বাজে বকছো বাবু। এদের এত রেগে যাওয়ার কারণটা খুলে বলো তো দেখি আগে।’
‘কারণ তো আপনারাই সাহেব।’
জেনারেল লয়েডের মুহূর্তের জন্যে মনে হল তাঁর বন্দুকটা এনে লোকটাকে এখানেই নিকেশ করে দেন। সাহস দেখো এই বজ্জাত বাঙালিটার, তাঁরই সামনে বসে তাঁদেরই দোষারোপ করছে? মনের রাগ মনেই চেপে রাখলেন তিনি, ভুরু কুঁচকে জিজ্ঞাসা করলেন ‘হোয়াই বাবু, এরকম বলছো কেন?’
খিক খিক হাসলেন চওধরী সা’ব, এই হাসিটা শুনলেই জেনারেল লয়েডের গা জ্বলে যায়, তিনি অপলক চোখে সামনের দিকে তাকিয়ে রইলেন।
‘সে কী সাহেব, চিরস্থায়ী বন্দোবস্তটা এ দেশে কারা চালু করেছিল? আপনারা নন?’
বাঘাটে চোখে চেয়ে থেকে একটা হুঙ্কার ছড়লেন জেনারেল লয়েড, ‘তো?’
খিক খিক করে ফের সেই গা জ্বালানো হাসি, ‘তা সাহেব এই সব জায়গাজমি যখন একধার থেকে বাইরের লোকের হাতে তুলে দিলেন, একবারও ভেবেছিলেন, এই সাঁওতালরা জমির খাজনা দেবে কী করে?’
‘বাকিরা যা করে দেয়, পুরো বেঙ্গল প্রেসিডেন্সি যে ভাবে দেয়, সেভাবেই দেবে।’ জেনারেল লয়েডের স্বরে বিরক্তি আর উষ্মা গোপন থাকছিল না।