কোথাও কিছু নেই, হঠাৎ আমার গা’টা যেমন কেমন যেন শিউরে উঠল। স্লেটে কখনও কাউকে লম্বা নখ দিয়ে আঁচড় কাটতে শুনেছিস? অবিকল সেই শব্দ। টিমটিমে আলোয়, বৃষ্টিভেজা জনমানবহীন সন্ধ্যায় সামান্য খোনা গলায় বলা চারটে শব্দ শুনে যেন আমার বুকের রক্তটা জমাট বেঁধে গেল!’
এইখানে দীপুপিসি একবার ফের থামলেন। এতটা শুনেই আমার গলার কাছটা ঘেমে উঠছিল। খেয়াল করলাম যে পলির হাতের নখগুলো আমার হাতে গেঁথে বসছে। আড়চোখে মৌ-এর দিকে তাকালাম, মেয়েটা যা বড় হাঁ করে আছে, তাতে ও এখন স্বচ্ছন্দে একটা বিগ ম্যাক কামড়াতে পারে! পাশের টেবিলে রাখা গ্লাস থেকে একঢোঁক জল খেয়ে পিসি শুরু করলেন, ‘মহুয়ার অবশ্য সেদিকে ভ্রূক্ষেপ নেই, কীরে দীপু, দাঁড়িয়ে রইলি কেন, চল চল..দেরি হয়ে যাচ্ছে যে, বলে আমাকে প্রায় টানতে টানতে রিকশার দিয়ে নিয়ে চলল। রাস্তাটা ক্রস করছি, আমার চোখ লোকটার দিকে, আর খেয়াল করছি যে লোকটা এক দৃষ্টিতে মহুয়ার দিকে তাকিয়ে আছে। আর এমন তন্ময় হয়ে তাকিয়ে আছে, আমি যে ওকে দেখছি সে দিকে ওর কোনও নজরই নেই।
আরও কাছে আসতে লোকটাকে আরও লক্ষ্য করলাম। লোকটার কোঁকড়ানো চুল, চ্যাপ্টা নাক আর ঘোর কালো গায়ের রং দেখলে মনে হওয়া স্বাভাবিক যে লোকটা সাঁওতাল বা অন্য কোনও আদিবাসী মানুষ। কলকাতার রাস্তায় আজ অবধি যত রিকশাওয়ালা দেখেছি তারা সব্বাই বিহারি, আজ অবধি কোনও ট্রাইবাল মানুষকে এ কাজ করতে দেখিনি। ওখান থেকেই আমার খটকা লাগা শুরু। লোকটার গায়ে ওপরে কিছু নেই, নীচে একটা খাটো নোংরা ময়লা ধুতি মতো পরে আছে। তবে এসব ছাড়া প্রথমেই যেটা নজরে আসে সেটা হচ্ছে লোকটার চোখ দুটো। এত জীবন্ত আর লাল সেই চোখদুটো যে চট করে দেখলে মনে হয় চোখের মাঝখানে যেন লাল টকটকে জ্বলন্ত কয়লা বসানো আছে। বাপ রে, সে কী ধ্বকধ্বক করে জ্বলতে থাকা দৃষ্টি। তারই সঙ্গে চোখদুটোর মধ্যে একটা চাপা উল্লাসের ছোঁয়া, যেন কোনও কারণে তার রাগ আর আনন্দ দুটোই যেন আর বাঁধ মানতে চাইছে না!
লোকটাকে তাই দেখেই আমার একটা অস্বস্তি হওয়া শুরু হল। তোরা তো জানিস, ভয়ডর জিনিসটা ছোটবেলা থেকেই আমার কম, তবুও অস্বস্তিটা এড়াতে পারছিলাম না। শুধু কাছে আসতে খেয়াল করলাম লোকটার বুকের বাঁদিকের একটু ওপরের দিকে, কণ্ঠার একটু নীচে একটা মোটা কাটা দাগ। মহুয়ার অবশ্য অতশত খেয়াল নেই। সে প্রায় লাফিয়ে উঠল রিকশায়, আমাকেও হাতে ধরে টেনে তুলল। তারপর টুংটুং করতে করতে রিকশাটা রওনা দিল শিয়ালদা’র দিকে।
সেই রাতটার কথা ভোলা খুব মুশকিল, বুঝলি! এখনও চোখ বন্ধ করলেই দেখতে পাই। একদম ফাঁকা নির্জন রাস্তা, নেড়িকুত্তা অবধি নেই। কলকাতা শহরের কোনও রাস্তা যে রাত আটটা’টার সময়ে অত জনমানবহীন হতে পারে সেটা না দেখলে বিশ্বাস হয় না। থেকে থেকে মেঘের চাপা গুরুগুরু গর্জন, আর ঝলকে ঝলকে বয়ে আসা ঠান্ডা হাওয়া আর এরই মধ্যে আধা-আলো আধা-অন্ধকারের মধ্যে রিকশায় চড়ে আমরা দুই বন্ধু যাচ্ছি শিয়ালদা’র দিকে।
হাওয়ার সঙ্গে কিছু ধুলো আর গাছের পাতাফাতাও আমাদের গায়ে এসে পড়ছিল বটে, তবে খানিকক্ষণ যাওয়ার পর খেয়াল করলাম যে, আরও একটা জিনিস আমাদের গায়ে উড়ে এসে পড়ছে বারবার।
ছাই!
কাগজ পোড়ানো ছাই না। কাঠ পুড়ে গেলে যে সাদা কালোয় মেশানো ছাই উড়ে বেড়ায়, সেই ছাই। অল্প অল্প করে সেই সূক্ষ্ম ছাইয়ের কণা উড়ে আসছে আমাদের দিকে, আর সেই ধূসর রঙের ছাইয়ে আস্তে আস্তে আমাদের সালওয়ার আর হাত মুখ ভরে যাচ্ছে। সামনে তাকালে দেখতে পাচ্ছি যে রাস্তা জুড়ে ছড়িয়ে থাকা সেই হলদেটে আলোর মধ্যে থেকে ছোট্ট ছোট্ট ছাইয়ের কণা উড়ে আসছে আমাদের দিকে।
এত ছাই কোথা থেকে এল? প্রথমে বুঝতে পারিনি ব্যাপারটা। অনেকক্ষণ ধরে তাকিয়ে থাকার পর যখন ধরতে পারলাম, এবং সে ব্যাপারটা এতই অবিশ্বাস্য, যে ভাবলে এখনও আমার গায়ে কাঁটা দেয়!’
অরিজিৎ ফ্যাঁস- ফ্যাঁসে গলায় বলল, ‘কেন পিসি?’
ফিসফিস স্বরে পিসি বললেন, ‘কী দেখলাম জানিস? সেই ছাইগুলো উড়ে আসছে লোকটার গা থেকে! মানে সেই বাদলা হাওয়ার মধ্যে দিয়ে লোকটা রিকশা হাতে প্রায় উড়ে চলেছে, আর তার গা থেকে যেন হঠাৎ সেই ছাইয়ের দল ধেয়ে আসছে আমাদের দিকে।
ব্যাপারটা এতই অবিশ্বাস্য লেগেছিল আমার কাছে, যে তোদের বলে বোঝাতে পারব না। অথচ নিজের চোখের সামনে ঘটছে ব্যাপারটা, ও কিছু নয়—বলে উড়িয়ে দিতেও পারছি না! কী করব সেটা ভাবতে ভাবতেই দেখি ততক্ষণে বৈঠকখানা বাজারের কাছাকাছি এসে গেছি। একটু দূরে দেখতে পাচ্ছি দোকানের আলো, লোকজনের চলাফেরা। দেখে বুকে বেশ কিছুটা বল এল। আর ঠিক সেই সময়েই পথের ধারে সাইড করে রিকশার হ্যান্ডেলটা নীচে নামিয়ে রাখল লোকটা।
মহুয়া তো অবাক! ও বলল, সে কি? আর যাবে না?
সেই স্লেটের ওপর আঁচড় কাটার মতো ক্যারক্যারে গলায় জবাব এল, ‘নেহি।’
মহুয়া তর্ক করতে যাচ্ছিল, কিন্তু আমার এই লোকটার সঙ্গ আর একটুও পছন্দ হচ্ছিল না। আমি বললাম, ছাড় না মৌ, টাকা দে আর চল। এসেই তো গেছি। বলে রিকশা থেকে নেমে একটা পাঁচটাকার নোট সিটের ওপর প্রায় ছুঁড়ে দিয়েই আমরা ঘুরে দাঁড়ালাম হাঁটা লাগাব বলে।