ধীরে ধীরে নীচু হয়ে একটা ঢিল কুড়িয়ে নেয় রাখহরি, তারপর সেটা ছুঁড়ে দেয় দূরের একটা ঝোপের দিকে। উদ্দেশ্য ছিল যে পিশাচটার দৃষ্টি ওদিকে ঘুরিয়ে দিলে সে যদি এক দৌড়ে নিতাইয়ের শরীরটা টেনে অন্য জায়গায় নিয়ে যেতে পারে। মানে যতক্ষণ এই অসম লড়াইতে সে বেঁচে থাকতে পারে ততক্ষণই তার জিত। ভোর হতে আরও ঘণ্টা দু-আড়াই। এই সময়টা পার করতে পারলেই…
প্রথম দিকে রাখহরির মতলবটা খেটেও গেছিল বটে, ঢিলটা অনেক দূরেই তাক করে ফেলেছিল রাখহরি, পিশাচটা দৌড়েও গেছিল সে দিকে। মুশকিলটা হল যখন নিতাইয়ের শরীরটা টেনে নিয়ে যাচ্ছিল ঠিক তখনই অস্বাভাবিক দ্রুততায় ঝড়ের মতো সেই বাঁশবন তছনছ করে তার সামনে এসে দাঁড়াল সেই দানব!
ধীরে ধীরে নিতাইয়ের অচৈতন্য নিথর শরীরটা মাটিতে শুইয়ে ফেলে পিছনের দিকে হেঁটে যাচ্ছিল রাখহরি। মাথা আর বোধবুদ্ধি গুলিয়ে যাচ্ছিল তার। দরদর করে ঘামছিল সে, তার মাথার ভেতরটা শূন্য হয়ে গেছিল এতক্ষণে। জীবনে এত বীভৎস আর ভয়াবহ অভিজ্ঞতা হয়নি তার।
তাকে কে টেনে আনল সেই বাঁশবনের দিকে? আর আনলোই যদি তো মারল না কেন? আর পরে তার গলাটা আঁকড়ে ধরলই বা কে? তার সামনে এখন কে? আর তখনই বা কে ছিল?
নরক থেকে উঠে আসা সাক্ষাৎ কালপিশাচটা তখন এক-পা এক-পা করে তার দিকে এগিয়ে আসছিল, তার মুখের থেকে রক্তের ফেনা উড়ে যাচ্ছিল আশেপাশের বাতাসে। সেই অমানুষিক ভয়াল বীভৎসতার সামনে এতক্ষণ ধরে জমিয়ে রাখা যাবতীয় সাহস একেবারেই উড়ে গেল রাখহরির। তবু তার মধ্যেই তার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা নরকের জীবটিকে চিনে নিতে অসুবিধা হল না তার! নিজেরই দু’চোখকে বিশ্বাস হচ্ছিল না! তাহলে সে যা ভেবেছিল, সত্যিই তাই?
অসহায় আতঙ্কে পালাতে গিয়েও পালাতে পারে না রাখহরি, উলটে পড়ে যায় মাঠের ওপর। স্থিরভাবে সে দেখে যে ধীরে ধীরে এসে তার ওপর দুদিকে দুই পা মেলে দাঁড়ায় সেই পিশাচ। উগ্র রক্তমাংসের গন্ধে আর ভয়ে বমি উঠে আসে রাখহরির।
ঈশ্বরের নাম জপছিল রাখহরি, তার মধ্যেই পিশাচটা তার বড় হাতদুটো নামিয়ে আনল রাখহরির কণ্ঠার ওপর। নারকীয় দুটো বড় বড় বাঁকানো নখ সবে নেমে এসেছে গলা বরাবর, চোখের সামনে তার ভয়াবহ মৃত্যু নেমে আসতে দেখে প্রায় অজ্ঞান রাখহরি, এমন সময় মনে হল পিছন থেকে কে যেন মাথাটা টেনে ধরল সেই পিশাচের।
আর তার পরেই শুধু একটা জিনিসই দেখতে পেল রাখহরি, একটু ওপর থেকে একটা বড় রামদা নেমে এল দনুর গলায়। ধড় থেকে মুণ্ডুটা আলাদা হয়ে গেল দনু পিশাচের।
আর নিতে পারল না রাখহরির স্নায়ু। শুধু অজ্ঞান হতে হতে দু’চোখ বুজে আসার আগে সে দেখল যে তার একপাশে তখনও পড়ে আছে ধড়ফড় করতে থাকা দনুর লাশ, আর বাঁ-হাতে সেই কাটা মাথাটা ধরে, ডানহাতে রক্ত চুঁইয়ে পড়া রামদা’টা টানতে টানতে মন্দিরের দিকে হেঁটে যাচ্ছে মুখুজ্জেবাড়ির নতুন বউ!
কিন্তু অজ্ঞান হতে হতেও একটা জিনিস দেখে স্তম্ভিত হয়ে যায় রাখহরি!
প্রথম থেকেই যে খটকাটা তার মাথায় ঘোরাফেরা করছিল, এক মুহূর্তে যেন সেটা দিনের আলোর মতো পরিষ্কার হয়ে গেল তার কাছে। প্রথমে সেই পুকুরের পাড়ে নিতাইয়ের টর্চের একঝলকের আলোয় জলপায়ের ছাপ দেখা ইস্তক এটাই তার মাথায় আটকে ছিল, কিন্তু তখন সেটা বোঝেনি সে। বুঝল এখন।
তার চোখের সামনে একের পর এক পা ফেলে খোঁড়াভৈরবীর মাঠ পেরিয়ে যাচ্ছে শামু, ওরফে শাম্ভবী। আর সেই পায়ের ছাপের মধ্যে ডানপায়ের বুড়ো আঙুলের ছাপের কোনও চিহ্ন নেই! তার জায়গায় শুধু রক্তের দাগ।
চোখ বুজল রাখহরি, ঠানদিদির কথা মনে পড়ে গেল তার। কালীগিরি তান্ত্রিক বলে গেছিলেন যে মায়ের যদি ইচ্ছে হয় তাহলে নিজের পুজোর ব্যবস্থা মা নিজেই করবেন। সেই কথাই খেটে গেল আজ, তালদিঘির খোঁড়াভৈরবী আজ নিজের পুজোর নৈবেদ্য নিজেই জোগাড় করে নিয়েছেন!
শামুর ডান পায়ের আঙুল কী প্রথম থেকেই ছিল না, নাকি তারই তলোয়ারের ঘায়ে আজ খোয়া গেল সেটা? সেটা মাথায় ঢোকার আগেই অজ্ঞান হয়ে পড়ে যায় এককালের দোর্দণ্ডপ্রতাপ ডাকাত রামাই সাধুখাঁ’র উত্তরাধিকারী, রাখহরি সাধুখাঁ!