চাপাস্বরে এক বার দুজনের নাম ধরে ডাকল নিতাই। অন্ধকার হাওয়া যেন বাঁশপাতার মধ্যে বয়ে গিয়ে খিলখিল হাসির শব্দ তুলতে লাগল নিতাইয়ের চারপাশে। নিতাইয়ের মনে হল যেন সেই অন্ধকার বাঁশবন তাকে গিলে খেতে আসছে। এই প্রথম ভয় পেল নিতাই, তীব্র ভয়!
বাঁ-দিকে একটু সরলো নিতাই, তার পায়ের নীচে মড়মড় করে উঠল শুকনো পাতার দল। অন্ধকারের মধ্যেই ঠাহর করে বাঁশবনের মধ্যে দিয়ে অন্যদিকে যেতে চাইছিলো সে। ধীরে, খুব ধীরে পা ফেলতে লাগল সে।
আর ঠিক সেই সময়েই ব্যাপারটা কানে এল তার।
ঠিক যখনই সে পা ফেলছে পাতার ওপর, ঠিক তখনই আরেকজনও পা রাখছে শুকনো পাতার স্তূপের ওপর। যেন নিতাইয়ের পাতা মাড়িয়ে যাওয়ার শব্দে লুকোতে চাইছে নিজের পায়ের শব্দ। সেই নির্জন অন্ধকারের মধ্যে কে যেন অতি যত্নে, অতি সন্তর্পণে অনুসরণ করছে তাকে!
প্রবল ভয়ে ঠকঠক করে কাঁপতে লাগল নিতাই। শীতের রাতেও দরদর করে ঘামতে লাগল সে। তবুও তার মধ্যেই এক-পা দু-পা করে এগোচ্ছিল নিতাই। মাঝে মাঝে তাকে অনুসরণ করার শব্দটা দূরে সরে যাচ্ছিল, মাঝে মাঝে একেবারে কাছে চলে আসছি, কিন্তু নিতাইয়ের সবসময়েই মনে হচ্ছিলো যে একজোড়া লাল টকটকে চোখ যেন অনুসরণ করছে তাকে। বুকটা হাপরের মতো ওঠানামা করছিল নিতাইয়ের, নিজের শ্বাসের শব্দ নিজেই শুনতে পাচ্ছিল সে।
হাতড়াতে হাতড়াতে সামনে একটা বড় ঝোপ পায় নিতাই, ছোটবেলায় লুকোচুরি খেলতে খেলতে এখানে বহুবার লুকিয়েছে সে। তার আড়ালে বসে একটু জিরোতে যাবে নিতাই, ঠিক সেই সময় আকাশ বাতাস শিউরে দিয়ে কে যেন ডেকে উঠল খোনা গলায়, ‘আয় রে আয়, আয় রে আয়…’
সেই ডাক শুনে বুকটা খালি হয়ে গেল নিতাইয়ের। কোনও দিকে না তাকিয়ে দিগ্বদিক জ্ঞান হারিয়ে দুদ্দাড় করে দৌড়তে লাগল সে। তার গায়ে সপাং সপাং করে বেত মারতে লাগল কচি বাঁশের ডগাগুলো। সেসব গ্রাহ্য করল না নিতাই, পাগলের মতো দৌড়তে লাগল। এক একটা মুহূর্ত অনন্তকাল বলে মনে হচ্ছিল তার।
মনে নেই কতক্ষণ পাগলের মতো দৌড়েছে সে, এমন সময় হঠাৎ করেই যেন বাঁশবনটা শেষ হয়ে গেল তার সামনে। থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল সে।
সামনে খোঁড়া ভৈরবীর মাঠ।
আর সেই মাঠের পাশে, বাঁশবনের ধার ঘেঁষে ওটা কী?
বা, ওটা কে?
একদলা আঁধার যেন কীসের ওপর ঝুঁকে বসেছিল তার দিকে পেছন ফিরে। নিতাইয়ের পায়ের শব্দ শুনে সেই ঘোর কালো অন্ধকার ফিরে তাকালো তার দিকে। তারপর ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়াল। তার টকটকে লাল চোখদুটো দেখে ধ্বক করে বুকটা যেন মুহূর্তের জন্যে গলায় আটকে গেল নিতাইয়ের।
লাল টকটকে জিভ বার করে একবার যেন ঠোঁট চেটে নিল সেই জমাট কালো অন্ধকার, তারপর খিলখিল করে হেসে উঠল সে…সেই অপার্থিব হাসি শুনে শরীরের প্রতিটি রক্তের ফোঁটা জমে গেল নিতাইয়ের। হাতে পায়ে আর বল পেল না সে, হাঁটু ভেঙে বসে পড়ল। আর ঠিক তখনই তার চোখে পড়ল কার ওপর এতক্ষণ ঝুঁকে পড়ে ছিল সেই অন্ধকারের পুঞ্জ।
রাখহরির শরীর।
আস্তে আস্তে চোখ ওপরে তোলে নিতাই, দেখে যে আগুনের ভাঁটার মতো চোখে তার দিকে কিছুক্ষণ চেয়ে থাকে সেই দলা দলা কালো ছায়া। তারপর নিতাইয়ের পিছনের অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে খিল-খিল করে হেসে উঠে ডানহাতে কী একটা যেন তুলে ধরে সে!
তাদের বাড়ির রামদা’টা!
আর সহ্য হয় না নিতাইয়ের, অজ্ঞান হয়ে পড়ে যায় সে।
আর ঠিক সেই সময়েই চোখ খুলে তাকায় রাখহরি। জ্ঞান ফিরে পেয়ে কয়েক মুহূর্ত ভোম মেরে ছিল বটে, কিন্তু তারপরেই হুঁশে ফিরে আসে সে। আর দেখে যে অপার্থিব ছায়ার ডেলা তাকে টেনে এনেছিল এই বাঁশবনের কিনারে, সেই-ই একটা বড় রাম’দা তুলেছে সামনে অজ্ঞান হয়ে থাকা নিতাইয়ের দিকে।
আর থাকতে পারল না রাখহরি। এককালে মুখুজ্জে পরিবারের অনেক নুন খেয়েছে তার পরিবার। আজ প্রাণ থাকতে তাদেরই এক সন্তানকে বেঘোরে মরতে দেবে রাখহরি? তার রক্তে ঘুমিয়ে থাকা ভয়ডরহীন আধা ডাকাতটি যেন হঠাৎই ঘুম থেকে জেগে উঠে রক্তচক্ষু মেলে চাইল চারিদিকে। পিঠের দিকে গুঁজে রাখা আধহাতি তলোয়ারটা হাতড়ে হাতড়ে বার করে সেই অন্ধকারের রাক্ষস, থুড়ি রাক্ষসিটার পায়ে বসিয়ে দিল রাখহরি সাধুখাঁ।
প্রথমে তলোয়ারটা অনেকটাই গুঁজে দিতে পেরেছিল বটে রাখহরি। কিন্তু তারপরই তাকে এক লাথিতে দশ হাত দূরে ফেলে দেয় সেই পিশাচিটা, তাতে তার অমানুষিক জোরটা টের পায় রাখহরি। তার গুরুদেব তাকে শিখিয়েছিলেন যে মারামারির সময় কখনও মাথা গরম করতে নেই। এতদিন বাদে বোধহয় গুরুর শিক্ষাটা কাজে দিল তার। উড়ে গিয়ে মাটিতে পড়তেই কিছুটা গড়িয়ে যায় রাখহরি, তারপর দ্রুত উঠে একটা ঝোপের আড়ালে চলে যায় সে।
সেখানে বসে দম নিচ্ছে সে, ঠিক তখনই একটা মোটা মোটা নখওয়ালা থাবা দিয়ে কে যেন তার গলাটা চেপে ধরে পেছন থেকে!
আতঙ্কের থেকেও বেশি হতবাক হয়ে গেছিল রাখহরি, এ আবার কার হাত? তবে কিনা চোদ্দো বছর ধরে জামালউদ্দিন ওস্তাদের কাছে মিছেই দেহবন্ধন আর নানান শারীরিক কসরৎ শেখেনি সে এককালে। এক ঝটকায় সেই অমানুষিক থাবা থেকে নিজেকে মুক্ত করে পাশের ঝোপে ঝাঁপ দিয়ে পড়ে রাখহরি।
যে থাবাদুটো রাখহরির গলা টিপে ধরেছিল, সে হাতদুটো থমকে যায় একটু, তারপর এক-পা এক-পা করে ইতিউতি হাওয়ায় গন্ধ শুঁকতে থাকে সে হাতদুটোর মালিক, যেন বোঝার চেষ্টা করে যে রাখহরি ঠিক কোথায় আছে।