বটগাছের কাছে এসে ওরা হদিস পায় না যে কোনদিকে যাবে, দুদিকে দুটো রাস্তা গেছে। এমন সময় হাতের ছোট টর্চটা মাটির দিকে নামিয়ে একবার জ্বালিয়েই বন্ধ করে দেয় নিতাই, সেই সেকেন্ডের ভগ্নাংশের মধ্যে জ্বলে ওঠা আলোয় ওরা দুটো জিনিস দেখতে পায়।
এক, দুপাটি নুপূর কে যেন খুলে রেখে গেছে তেমাথার মোড়ে, তাতে সিঁদূর লাগানো।
আর দুই, মাটিতে জলপায়ের ছাপ। জলের ফোঁটায় আর পায়ের ছাপে মিলেমিশে একটু অস্পষ্ট হয়ে গেলেও বোঝা যায় যে এই পুকুরে পা ডুবিয়ে কেউ হেঁটে গেছে দক্ষিণমুখো।
ওইদিকেই খোঁড়া ভৈরবীর মাঠ, তিনজনে চুপচাপ হাঁটা দেয় সেদিকে।
রাখহরির মনে হচ্ছিল টর্চের চকিত আলোয় আরও কী যেন একটা দেখল ও, কিন্তু সেটা যে ঠিক কী সেটা মাথায় বসছিল না তার। কী যেন দেখল ও? কী যেন একটা অস্বাভাবিক কিছু নজরে পড়ল না? এই দমবন্ধ করা ভূতুড়ে পরিবেশে অস্বস্তি হতে থাকে রাখহরির।
হাঁটতে হাঁটতে ওরা টের পাচ্ছিল যে সেই পচা মাংসরক্ত মেশানো গন্ধটা ধীরে ধীরে বাতাসে পাক খেয়ে খেয়ে মিশছে। চারিদিকে অমাবস্যার মিশমিশে কালো অন্ধকার, তারার আলোও দেখা যায় না আকাশে। তার মধ্যেই কাঁচা পথ ছেড়ে পাকা রাস্তায় ওঠে ওরা। রাখহরি আর নিতাই গ্রামের মানুষ, আঁধারে তাদের চোখ জ্বলে। অসুবিধা হচ্ছিল দনুর, শহরের লোক সে, রাতের অন্ধকারে রাস্তাঘাটে চলা অভ্যেস নেই। পদে পদে হোঁচট খাচ্ছিলো সে।
মিনিট পাঁচেক হাঁটার পর বাঁ-পাশে বাঁশবাগান এল, সেটা পেরোলেই মাঠ। আর সেখানে আসতেই একটা অবয়ব নজরে পড়ল ওদের!
এখান থেকেই দেখা যাচ্ছে যে একটা ছায়ামূর্তি রাস্তার শেষ দিকে ওদের আগে আগে হাঁটছে, রাস্তা পেরিয়ে মাঠে নামবে এবার। সেই ঘোর অন্ধকারের মধ্যেও সেই কালো ছায়াটির অবয়ব চিনতে ভুল হয় না ওদের।
ওটা শামু।
কিন্তু শামুর হাতে লম্বা মতো ওটা কী ঝুলছে?
তিনজনেই চট করে একটু রাস্তার বাঁ-পাশে বাঁশবাগান ঘেঁষে সরে আসে। ধীরে ধীরে পিছু নিতে হবে শামুর। দেখতে হবে যে, ও কোথায় যাচ্ছে। বিন্দুমাত্র শব্দ হলেই সর্বনাশ।
ঠিক এইসময় পিশাচের গায়ের পচা গন্ধটা যেন এই অন্ধকারের মধ্যেই হঠাৎ দপ করে বেড়ে উঠল। প্রবল বেগে বমি উঠে আসতে লাগল ওদের। যদিও শামুর দিক থেকে নজর সরাচ্ছিল না ওরা। শামুও যেন মাঠে নামার আগে একবার থমকে দাঁড়াল। তারপর শিয়াল যেমন নাক উঁচিয়ে বাতাসে গন্ধ শোঁকে ঠিক সেইভাবে মাথা উঁচু করে কী যেন শুঁকতে লাগল সে।
নিজের বুকের ধক ধক আওয়াজ শুনতে পাচ্ছিল নিতাই। কী করছে শামু? তাদের গায়ের গন্ধ শুঁকছে? এইবার শামু পিশাচীর শিকার কী ওরা? নিতাইয়ের পিঠটা খামচে ধরেছিল দনু বা রাখহরির মধ্যে কেউ একজন, সে হাতটা থরথর করে কাঁপছিল। শ্বাস বন্ধ করে মাথা নীচু করে বসে ছিল ওরা, ঠিক সেইসময়ে একটা অঘটন ঘটে গেল। পাশে সরতে গিয়ে একটা ছোট গর্তে পা পড়তে ‘আহ’ করে উঠল রাখহরি।
সেই শব্দ শুনে ধীরে, অতি ধীরে পিছনে ঘুরল শামু। আর তারপর টকটকে চোখদুটি মেলে সোজা তাকালো তাদের দিকে।
এরপর সেই ঘোর অন্ধকারের আকাশ আর আর মাঠ পিছনে রেখে, ধীরেসুস্থে হাতের লম্বা জিনিসটার মাথা মাটিতে ঘষটাতে ঘষটাতে আস্তে আস্তে তাদের দিকে এগিয়ে আসতে লাগল সেই অবয়ব, একটু আগেও যাকে নিতাই চিনতো শামু বলে। নিতাইয়ের চোখের তারা নড়ছিল না বিন্দুমাত্র, সেই অন্ধকার রাতে তার চোখের সামনে ফুটে উঠেছিল এক আশ্চর্য ভয়াল ছবি। শামুর পিছনে নিঃশ্বাস বন্ধ করে দাঁড়িয়ে আছে এক শব্দহীন নীলকালো রঙের আকাশ, আকাশের শেষে একপ্রান্তে নিঃসাড়ে ফুটে আছে একটি অসহায় আলোহীন মন্দিরের ছায়া, আর মন্দিরের পায়ের কাছে বিছিয়ে আছে একটি ধূ-ধূ করা মাঠ, খোঁড়াভৈরবীর মাঠ!
সেই মাঠের সামনে সরু পথ ধরে এগিয়ে আসছে একটি নারীমূর্তি, যার হাতে ধরা জিনিসটার মাথা রাস্তার মাটিতে পাথরে ঠেকে ভীতিপ্রদ আওয়াজ তুলছে,
ঠংং ঠংং ঠংং…
ভয়ে যেন পাথর হয়ে গেল নিতাই, তার কাঁধ খামচে ধরা হাতের ব্যাপারে তার মনেই রইল না আর। অজগরের চোখের দিকে যেমন তাকিয়ে থাকে ছাগলছানা, ঠিক তেমনই সামনের দিকে চেয়েছিল সে।
ধীরে ধীরে সেই ছায়ামূর্তিটা আরও কাছে আসে তার। এতক্ষণে তার হাতে ধরা জিনিসটির আন্দাজ পায় নিতাই! যে রাম’দাটা দিয়ে তাদের বাড়িতে জ্যান্ত পাঁঠা কাটে বিশু কামার, সেইটাই শামুর হাতে!
আজ আর তাহলে খালিহাতে নয়, অস্ত্রহাতে শিকারে বেরিয়েছে তালদিঘির পিশাচ!
পা’টা আটকে গেছিল নিতাইয়ের, চারপাশের আর যেন কিছু তার নজরে ছিল না। মন্ত্রমুগ্ধের মতো সামনের দিকে চেয়ে আছে সে, ঠিক সেই একটাই ঘটনা ঘটল।
নিতাইয়ের চোখের সামনে হঠাৎ করে একটা কুয়াশার মিহি পর্দা যেন নেমে এল রাস্তার মধ্যিখানে। অবশ্য বেশিক্ষণের জন্য নয়, কয়েক সেকেন্ডের বেশি হবে না। পরক্ষণেই সরে গেল পর্দা, আর দেখা গেল যে ওর সামনে আর কিচ্ছু নেই, সব ফাঁকা!
শামু উধাও!
ব্যাপারটা এত চকিতে ঘটে গেল যে ধাঁধা লেগে গেল নিতাইয়ের। মনে হল হঠাৎ করেই যেন উবে গেল সামনের লোকটা।
আস্তে আস্তে বাঁশবনের মধ্যে আরও খানিকটা সেঁধিয়ে গেল নিতাই। আর ঠিক তখনই খেয়াল হল যে তার পাশে দনু বা রাখহরি, দুজনের কেউ নেই।