‘কী বলে গেছিল কালী তান্ত্রিক?’ ফিসফিসিয়ে জিগ্যেস করে দনু।
‘বলে গেছিল যে…মায়ের যদি ইচ্ছে হয় তাহলে নিজের পুজোর ব্যবস্থা মা নিজেই করবেন।’
শুনেই লাফিয়ে ওঠেন অধীর সাঁপুই, ‘ধুর, এটা একটা সমাধান হল?’ হতাশা ঝরে পড়ে তাঁর স্বরে, ‘এ তো একটা কথার কথা, এরকম তো আমরা হামেশাই বলে থাকি। বলি উনি কি কোনও কাটান বা মন্তর বলে গেছিল তোমার ওই পূর্বপুরুষকে? যেটা কিনা তাঁর ছেলে, ছেলের ছেলে এই করে করে তোমাদের কারও কাছে জানা আছে?’
অসহায়ের মতো মাথা নাড়েন ঠানদিদি, ‘না রে ভাই, এমন কিছু তো বাবা আমাকে বলে গেছে বলে মনে পড়ে না!’
‘আপনার আর কোনও ভাই বা বোন নেই ঠানদিদি?’ প্রশ্ন করেন মুখুজ্জেমশাই।
‘না রে ভাই, আমার তো আর কোনও জ্ঞাতিগুষ্ঠি কেউ নেই।’
‘তাহলে আর কী মুখুজ্জেমশাই, এই গাঁ থেকে বাস ওঠাতে হবে মনে
হচ্ছে,’ হতাশ শোনায় রায়বাবুর গলা, ‘গিন্নি কথাটা অনেকদিন ধরেই বলছিলেন বটে। কালই তবে আমরা পাটনা চলে যাচ্ছি মেয়ের কাছে। মা যদি চান তবেই ফিরব, নচেৎ নয়। চললাম মুখুজ্জেমশাই, চললাম ভাইসব, সাবধানে থাকবেন, ভৈরবী মা সবার মঙ্গল করুন।’ বলে চাদরটি কাঁধে দুলিয়ে বাইরের দিকে হাঁটা দেন রায়মশাই।
সেই শেষ দেখা রায়বাবুর। পরের দিন ভোরবেলা পাশের গ্রাম জগতবল্লভপুরের একজন মুনিষ এসে খবর দেয় যে দুই গাঁয়ের মধ্যিখানে যে শুকনো খালটা আছে তার মধ্যে রায়বাবু পড়ে আছেন। রায়বাবু বলতে তাঁর শরীরটার কথাই বলেছিল সে। কোমরের নীচ থেকে অর্ধেক খাওয়া, মাথাটা উলটো করে ঘোরানো। তবে তার থেকেও যেটা ভয়ানক সেটা হচ্ছে যে বাকি শরীরটা কে যেন ধারালো রামদা জাতীয় কিছু একটা দিয়ে প্রবল আক্রোশে কুপিয়ে খণ্ড খণ্ড করে রেখে গেছে।
আর খালের মাটি ভেদ করে, রায়বাবুর খুলি ফাটিয়ে মুখ ফুঁড়ে উঠেছিল একটা পুরোনো, শ্যাওলা ধরা হাড়ের টুকরো!
নিঃসাড়ে ঘুমিয়েছিল নিতাই। মানে ঘুমের ভান করে একপাশ ফিরে শুয়েছিল বিছানায়। আজ অমাবস্যা, যেদিন তার মা ভৈরবী মন্দিরে পড়ে গেছিল তারপর ঠিক পনেরো দিন হল আজ। তার ওপর আজ সূর্যগ্রহণও বটে। কালী তান্ত্রিকের কথা সত্যি হলে আজই একটা এসপার বা ওসপার হয়ে যাওয়ার কথা।
আজ খোঁড়াভৈরবীর মন্দিরে ধুমধাম করে অমাবস্যার পুজো হওয়ার কথা ছিল, প্রতি অমাবস্যাতে তাই হয়। কিন্তু এইবার আর কেউই সন্ধের পর বাড়ির বাইরে থাকার ঝুঁকি নেয়নি, সবার কাছেই ভক্তির থেকে ভয়ের দাম বেশি। ফলে গত তিনশো বছরের মধ্যে এই প্রথম অমাবস্যার পুজোয় নিষ্প্রদীপ থাকবে খোঁড়া ভৈরবীর মন্দির।
মাঝরাত শেষ হয়েছে কি হয়নি, বাইরে একটা শনশন হাওয়া উঠল। তারই মধ্যে নিতাইয়ের মনে হল কে যেন দূর থেকে মেয়েলি গলায় একবার ‘আয় আয় আয়’ করে ডেকে গেল, সেই ভূতুড়ে ডাকে গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল তার। চোখ বুজে শুয়ে আছে নিতাই, ঠিক এমন সময় বাইরের হলঘরের বড় ঘড়িটায় ঢং করে একটা শব্দ হল।
রাত একটা।
এইবার বিছানায় একটা মৃদু নড়াচড়া টের পায় নিতাই। চোখ বুজে থাকলেও শরীরের বাকি সমস্ত ইন্দ্রিয়গুলো সজাগ হয়ে ওঠে তার, পেশিগুলো টানটান হয়ে যায়।
শামু উঠছে বিছানা ছেড়ে।
নাক ডাকার শব্দটা বাড়িয়ে দেয় নিতাই। বুঝতে পারে যে উঁচু খাট থেকে হালকা পায়ে ঘরের মেঝেতে লাফিয়ে নামল শামু। ঝুন করে একটা আওয়াজ হল নুপূরের।
মিনিট তিনেক অপেক্ষা করে উঠে পড়ে নিতাই। বিছানা থেকে নেমে ঘরের বাইরে বেরিয়ে আসে সে। সারা বাড়ি চুপচাপ, কোথাও কোনও শব্দ নেই। শুধু দূর থেকে অস্পষ্টভাবে নুপূরের শব্দ আসছে তার কানে। কোনদিকে গেল শামু? বারান্দার দিকটা একবার দেখে নেয় নিতাই, নাহ একদম ফাঁকা।
খিড়কি দরজার দিকে আসতেই ঝুন ঝুন ঝুন শব্দটা ক্ষীণ হতে হতে মিলিয়ে যায়। মানে খিড়কি দরজা দিয়ে বেরিয়ে গেলো শামু। ওদিকে যেতেই সিঁড়ির নীচ থেকে ছায়ার মতো বেরিয়ে আসে দুইজন। তাদের একজনকে ফিসফিস করে প্রশ্ন করে নিতাই, ‘কাকা, তোমার বউমাকে দেখলে নাকি?’
সেইভাবেই চাপাস্বরে উত্তর দেয় রাখহরি, ‘এই তো এখান থেকে খিড়কি দরজার দিকে গেল। নুপূরের আওয়াজ তো শুনলামই…আর…’, কী একটা বলতে গিয়ে থেমে যায় সে।
‘আর কী কাকা?’ রুদ্ধশ্বাসে প্রশ্ন করে নিতাই।
‘বউদির চোখ দুটো না কেমন যেন জ্বলছিল, বুঝলে নিতাইদা…কয়লায় আগুন লাগলে যেমন লাগে…’ উত্তর দেয় দ্বিতীয়জন, দনু।
শিকারে বেরিয়েছে শামু? বুকটা ধ্বক করে ওঠে নিতাইয়ের। একটা চাপা কষ্টও যেন বুকে গুমরে উঠতে থাকে তার, তার বউই তাহলে সেই পিশাচ? এদ্দিন ধরে একটা পিশাচীকে নিয়ে ঘর করেছে সে?
তারপর চোয়াল শক্ত করে সে, আজ এর শেষ দেখে ছাড়বে নিতাই মুখুজ্জে।
‘অস্তর কিছু নিয়েছো?’ প্রশ্ন করে নিতাই।
রাখহরি নিয়েছে একটা আধহাতি তলোয়ার, আর দনু নিয়েছে একটা পাকা বাঁশের লাঠি। সব দেখেশুনে নিতাই বলে, ‘চলো যাওয়া যাক।’
খিড়কি দরজাটা ভেজানোই ছিল, অর্থাৎ শামু এখান থেকে এখনই বেরিয়েছে। ধীরে সন্তর্পণে ওরা তিনজন বাইরে আসে। এবার ওরা যাবে কোনদিকে? নুপূরের আওয়াজ শোনা যাচ্ছে না কেন?
বাঁদিকে এগোলে একটা ছোট মতন ফাঁকা জমি, আর ডানদিকে একটু এগোলে একটা বটগাছ। তার পেছনে মণ্ডলদের পুকুর, যে পুকুরের জলই সেদিন রক্তে ভেসে গেছিল। প্রথমে ওরা ডানদিকে যাওয়াই মনস্থ করে।