মা যেদিন মন্দিরে পড়ে গেলেন, তবে থেকেই কেমন যেন অদ্ভুত ব্যবহার করছে মেয়েটা। কথা নেই কারও সঙ্গে, চুপচাপ থাকে দিনের বেশিরভাগ সময়ে, কথা বলতে গেলে এমন চোখে তাকায় যে দেখে বুকের রক্ত ঠান্ডা হয়ে যায়।
তার থেকেও সাঙ্ঘাতিক ঘটনাটা ঘটে কয়েকদিন আগে।
প্রথম প্রথম এতসব খেয়াল করেনি নিতাই। তার ঘুম খুব গাঢ়, একবার বালিশ ছুঁলে তার আর সাড় থাকে না। তবে সেইদিন মাঝরাতে হঠাৎ ঘুম ভেঙে গেছিল নিতাইয়ের, উঠে অভ্যেসবশে পাশে হাত বাড়িয়ে যে দেখে পাশে বউ নেই! প্রথমে ভেবেছিল হয়তো বাথরুমে গেছে শামু, এসে পড়বে এখুনি। বেশ কিছুক্ষণ পরেও শামু আসছে না দেখে উঠে যায় নিতাই, গিয়ে দেখে বারান্দায় গ্রিলের গায়ে মুখ ঠেকিয়ে দাঁড়িয়ে বিড়বিড় করে অদ্ভুত সুরে মন্ত্রের মতো কীসব যেন চাপা গলায় নাকি কান্নার মতো আউড়ে যাচ্ছে তার নতুন বিয়ে করা বউ।
সেইদিন হঠাৎ অকারণেই শীত করে উঠেছিল নিতাইয়ের। চুপচাপ বিছানায় এসে শুয়ে পড়েছিল সে। তারও ঘণ্টাখানেক পরে ভোররাতে দিকে ফিরে আসে শামু।
কী করছিল সে অত রাতে? কোথায় গেছিল তার বউ?
‘শামু, ও শামু, গ্যালে কই?’ চাপাস্বরে ডাকতে ডাকতে বাড়ির অন্দরমহলে বউকে খুঁজছিল নিতাই। একটা কুটিল সন্দেহ তার মনে কয়েকদিন ধরে ক্রমেই ঘোট পাকিয়ে উঠছে। শুধু সেইদিন নয়, তারপর থেকেই রোজ রাতে ঘুমোবার পর বেশ কিছুক্ষণের জন্যে শামু যায় কোথায়? আর সেইসব রাতেই একটার পর একটা অঘটন ঘটে যায় কী করে?
‘শামু, শামুউউ, কই গ্যালে গো? লোকজন এসেছে, চা’টা করে দাও দিকি। বলি নিমকি-টিমকি আছে কিছু?’ বলতে বলতে রান্নাঘরের পেছনে এসে উপস্থিত হয় নিতাই। আর তারপর সামনের দৃশ্যটা দেখে শিরদাঁড়ায় একটা বরফের স্রোত নেমে যায় তার।
সেখানে তখন শামু পিঠ ফিরিয়ে বসে একটা অদ্ভুত কাজ করছিল। তার সামনে কঁক কঁক করে ছটফট করছে বাজার থেকে কিনে আনা দু-চারটে মুরগি, স্পষ্টতই ভয় পেয়েছে তারা। আর আছে একটা সদ্য কাটা পাঁঠা। এ-বাড়িতে মুরগি বা পাঁঠা বাজার থেকে কেটে আনা হয় না, জ্যান্ত আনা হয়। তারপর এই বাড়িতেই কেটেকুটে রান্না করা হয় তাদের। পাঁঠা কাটার জায়গাটা একটু দূরে।
খানিকক্ষণ আগে বিশু কামার এসে পাঁঠাটা কেটে দিয়ে গেছে, মাটিতে শোয়ানো আছে কাটা পাঁঠাটা। আর নিতাইয়ের বউ, সদ্য বিয়ে করা বউ সেই পাঁঠার রক্ত দু-হাতে তুলে নিজের সারা মুখে মাখছে আর রামদাটার ওপর আঙুলে করে ছিটিয়ে ছিটিয়ে দিচ্ছে! সঙ্গে সেই দুর্বোধ্য ভাষায় সুরেলা মন্ত্র আউড়ানো!
ধীরে ধীরে সরে আসে নিতাই, বুকটা ধড়াস ধড়াস করছিল তার। হা ঈশ্বর, এ কী দেখল সে? সে যা ভাবছিল তাহলে কী সেটাই সত্যি?
‘কিন্তু এর প্রতিকার কী মুখুজ্জেমশাই?’ আর্তনাদ করেন বগলাচরণ শিকদার, ‘কাজ কারবার সব লাটে উঠতে চলল যে। ছেলেমেয়ে পরিবার নিয়ে তো গাঁয়ে বাস করাই মুশকিল হয়ে দাঁড়াচ্ছে দেখছি। আপনিই বলুন, এভাবে বাঁচা যায় নাকি?’
রাখহরি একটা কথা ভাবছিল, ভ্রু’টা কুঁচকে ছিল তার, ‘আচ্ছা মণ্ডলদের ঠানদিদিকে একবার জিগ্যেস করলে হয় না? মানে কালীগিরি তান্ত্রিক এসব থেকে বাঁচবার কোনও কিছু মন্তর বা উপায় টুপায় কিছু বলে গেসলো কি না ঠানদিদির ওই সেই পূর্বপুরুষকে?’
কথাটা মনে ধরে সবার, এই কথাটা কারও মনে আসেনি কেন এতক্ষণ! তার ওপর ঠানদিদি এখন এ বাড়িতেই, বাসন্তীপিসির পরিচর্যার তদারক করছেন। মুখুজ্জেমশাই কাজের লোক কানাইকে ডেকে বলেন অন্দরমহলে খবর দিতে।
আধ হাত ঘোমটা টেনে একটু কুঁজো হয়ে এলেন ঠানদিদি। এঁদের সক্কলের থেকে বয়সে বড় হলে কী হবে, প্রাচীন যুগের লোক তিনি, ঘোমটা টোমটা বিলক্ষণ মানেন। দনু উঠে গিয়ে ঠানদিদির হাত ধরে যত্ন করে একটা মোড়ায় বসিয়ে দেয়, ‘বেঁচে থাকো বাবা,’ থুত্থুরে গলায় নাতির বয়সি নবীন মাস্টারমশাইটিকে আশীর্বাদ করেন ঠানদিদি। তারপর সমবেত ভদ্রজনের প্রশ্নটা শুনে অনেকক্ষণ ভুরু কুঁচকে টুচকে ভেবে বলেন, ‘কই না তো! এরম কিছু তো বাবা আমাকে বলে যায় নি রে ভাই।’
‘কিছুই বলে জাননি কালী তান্ত্রিক? ও ঠানদিদি, একটু চেষ্টা করো না, যদি কিছু মনে টনে থেকে থাকে তোমার’, অনুনয় করেন এক-দুজন।
ভুরু কুঁচকে কী সব যেন ভাবতে থাকেন ঠানদিদি। সেইদিকে সাগ্রহে চেয়ে থাকে সক্কলে। বেশ কিছুক্ষণ পর বিড়বিড় করে বলতে থাকেন তিনি, ‘একবার…একবার অবশ্য…বুঝলি ভাই…আমি তখন খুব ছোট…রাত্তিরে খেয়ে দেয়ে ঘুমের ভান করে শুয়ে আছি…মা এঁটো বাসনকোসন ধুয়ে এসে বাবার সঙ্গে গল্প করছে…এমন সময় কথায় কথায় এই খোঁড়া ভৈরবীর কথা ওঠে, বুঝলি? আমি…আমার তখন ঘুম আসি আসি করছে…মা ঠিক এটাই জিগ্যেস করল…চোখটা জুড়িয়ে আসার আগে…ঠিক শুনিনি…মনে হল বাবা বলছে…কী যেন বলল?’ বলে উদ্ভ্রান্ত চোখ দুটো তুলে সবার দিকে চাইলেন…’কী বলেছিল বলত বাছা! মনে পড়ে না কেন?’
এতক্ষণ সবাই নিঃশ্বাস বন্ধ করে শুনছিল ঠানদিদির কথা। কারও কিছু বলতে সাহস হচ্ছিল না। শুধু রাখহরি ফিসফিস করে বলল, ‘আরেকটু মনে করার চেষ্টা করো না ঠানদিদি। কী বলেছিল তোমার বাবা?’
চোখ বন্ধ করে মনে করার চেষ্টা করেন ঠানদিদি, কপালটা কুঁচকে যায় বুড়ো মানুষটার, ‘বাবা বলছিল…বাবা বলছিল যে…যে…আমাদের যে পূর্বপুরুষের জন্যে মায়ের মূর্তির আঙুল ভেঙেছিল…তিনি নাকি খুব ভয় পেয়েছিলেন…তখন তাঁকে নাকি কালী তান্ত্রিক সাহস দিয়ে বলে…কালীগিরি বলে গেছিল যে…কী যেন…হ্যাঁ …মনে পড়েছে…কালী তান্ত্রিক বলে গেছিল যে…’