বাকিরা আর দাঁড়াবার সাহস পায়নি, পিছনবাগে ফিরে দৌড় দেয়। শুধু দৌড়তে গিয়ে পড়ে যান সমাদ্দারমশাই।
সাহস করে আরও কিছুটা এগোয় রাখহরি। পচা বিশ্রী একটা গন্ধে নাড়িভুঁড়ি উঠে আসছিল তার, কাঁধের গামছাটা নাকে চেপে ধরে সে। আরও একটু এগোতেই নরম নরম কী যেন একটা তার পায়ে ঠেকতে থেমে গিয়ে সেদিকে টর্চ মারে রাখহরি।
একটা মানুষের হাত, কনুইয়ের নীচ থেকে কাটা। না, ভুল হল।
কাটা নয়, ছেঁড়া! তার গায়ে এখনও রক্ত লেগে!
খানিকক্ষণ স্তম্ভিত হয়ে সেদিকে চেয়ে থাকে রাখহরি, বুকটা ধ্বক করে ওঠে তার। মানুষের কাটা হাত-পা দেখার অভ্যেস বহুদিন নেই রাখহরির, তার ওপর জ্যান্ত মানুষের হাত যে ওভাবে মুচড়ে ছিঁড়ে আনা যায় সে কথা কোনওদিন স্বপ্নেও ভাবেনি সে।
দরদর করে ঘামতে থাকে রাখহরি, বুকটা ধড়াস ধড়াস করছিল তার। কাঁপতে কাঁপতে সামনের দিকে টর্চ ফেলে সে, আর স্ট্যাচু হয়ে যায়।
কী ওটা, কোন প্রাণি? থরথর করে কাঁপতে থাকা আলোয় রাখহরি দেখে প্রকাণ্ড একটা উলঙ্গ শরীর কীসের ওপর যেন ঝুঁকে পড়েছে, সারা শরীর বড় বড় কালো লোমে ঢাকা, কান বলে কিছু নেই আর বড় বড় বাঁকানো নখওয়ালা দুটো মোটা মোটা হাত দিয়ে কী একটা যেন ছিঁড়ে ছিঁড়ে খাচ্ছে। মাংসের গন্ধ ছাড়াও এবার আরও একটা উগ্র গন্ধ নাকে এল রাখহরি’র।
কাঁচা রক্তের গন্ধ।
এইবার সেই প্রাণীটা লাল টকটকে চোখ তুলে তাকাল ওপরের দিকে। আর সেই অমানুষিক বিভীষিকার দিকে তাকিয়ে ভয়ে প্রাণ উড়ে গেল রাখহরির, পেছন ফিরে পড়ি কি মরি করে ঊর্ধ্বশ্বাসে দৌড় দিল সে।
পালাবার আগে শুধু আর একটা জিনিসই চোখে পড়েছিল তার।
প্রাণীটা যেটার ওপরে ঝুঁকে পড়েছিল সেটা যে একটা শরীর তা চিনতে ভুল হয়নি রাখহরির। তারই কাটা মাথাটা আয়েশ করে খাচ্ছিল সে। আর ওই আতঙ্কের মধ্যেও শরীরটা কার সেটা দেখামাত্র চিনতে দেরি করেনি রাখহরি।
ওটা কার্তিক সমাদ্দারের শরীর।
মণ্ডলবাড়ির লোকজন অবশ্য এত কথা জানত না। পরদিন রাতভোরে মণ্ডলের ছোট মেয়ে তাপসী ঘুম থেকে উঠে তাদের বাড়ির পাশের ছোট পুকুরটায় মুখ ধুতে গিয়ে দেখে সারা পুকুরের জল টকটকে লাল, আর তাতে কাঁচা রক্তের গন্ধ।
কেউ যেটা দেখেনি, কখনও দেখবেও না, সেটা হচ্ছে যে পুকুরের নীচে পাঁক থেকে মাথা উঁচু করে বেরিয়ে এসেছিল একটা প্রায় গলে পচে যাওয়া হাতের হাড়!
বৈঠক বসেছিল মুখুজ্জেবাড়ির বাইরের ঘরে। গাঁয়ের পাঁচজন গণ্যমান্যরা উপস্থিত ছিলেন, ছিলেন যোগেন ভটচায্যি মশাই। ছিল আরও দুজন যারা সামনাসামনি দেখেছে সেই পিশাচকে, তারা।
রাখহরি আর দনু!
সারা গ্রাম জুড়ে একটা থমথমে সন্ত্রস্ত পরিবেশ। ভোরের আলো ফোটার আগে কেউ ঘরের বাইরে বেরোয় না, আর সন্ধে নামতে না নামতে ঘরের দরজায় খিল! তারপর চিল্লিয়ে গলা ফেড়ে রক্ত তুলে ফেললেও কাউকে পাওয়া যাবে না। গত দশদিনে আটজন শিকার করেছে তালদিঘির পিশাচ! তার সঙ্গে গেছে বছিরুদ্দি আর নাসিরের দুটো দুটো করে চারটে ছাগল, তারিণী কর্মকারের একটা বাছুর আর পাড়ার বোসেদের গোয়াল থেকে দুটো দুধেল গাই। আজকাল সন্ধের পর মানুষ তো দূর, কুকুরও দেখা যায় না তালদিঘির পথে। আশেপাশের গাঁ তো বটেই, এই গাঁয়ের বাসিন্দা যারা তাদের আত্মীয়স্বজনরাও আজকাল সভয়ে এড়িয়ে চলছে তালদিঘিকে।
পুলিশে অবশ্য প্রথামাফিক খবর দেওয়া হয়েছিলো, তারা চৌকিও বসিয়েছিল একখান। মস্ত একখান ভুঁড়ি দুলিয়ে আর মোটা গোঁফজোড়া মুচড়ে হাবিলদার রতনলাল চৌবে এসে বসেছিলো চৌকিতে। ‘কওনো বদমাশ উদমাস কর রহা হোগা ইয়ে সব। আনে দো সালেকো হামরে সামনে,’ ভজুয়ার দোকানের হিং দেওয়া গরমাগরম একধামা কচুরি বেশ আয়েশ করে চিবোতে চিবোতে সামনে হাত জোড় করে দাঁড়িয়ে থাকা জনা দশেক লোককে বলেছিল রতনলাল। তারপর একঘটি ঘন সর পড়া দুধ গলায় ঢেলে তৃপ্তির উদগার তুলে বাকি কথাটা একটু ভারী গলায় শেষ করেছিল সে, ‘একবার হামরে হাথ লগ যায়ে তো দেখনা। উলটা টাংগকে মারেঙ্গে সালেকো।’
পরদিন ভোরে চৌবেজি’র বেল্টটা আর একপাটি জুতোই শুধু পাওয়া গেছিল বাজারের মধ্যে, তখনও রক্ত লেগে ছিল দুটোতেই। অনেক খোঁজাখুঁজি করেও বডির কোনও হদিস পাওয়া যায়নি।
‘পুলিশ কী বলছে?’ চিন্তিত মুখে প্রশ্ন করেন রায়বাবু। এককালে উঁচু পোস্টে সরকারি চাকরি করতেন পরিমল রায়, তাঁর মতামতের একটা দাম আছে।
‘লোকাল থানা হাত তুলে দিয়েছে,’ হতাশ স্বরে বলেন মুখুজ্জেমশাই, ‘বড়বাবু বললেন ভূতপ্রেতের কারবার ওনার আন্ডারে পড়ে না। উনি রিপোর্ট লিখে সদরে ফাইল পাঠিয়ে দিয়েছেন। এরপর যা করবার ওপরওয়ালারা করবেন।’
‘তাহলে উপায়?’ শুকনো মুখে প্রশ্ন করেন সাঁপুইদের বড়কত্তা অধীররঞ্জন সাঁপুই, লোকে বলে গেঁড়ে সাঁপুই, ‘তদ্দিনে তো গাঁ ফাঁকা হয়ে যাবে দাদা। আট আটজন লোক…’
‘আট নয় কাকা, নয়জন,’ চিন্তিত মুখে বলে রাখহরি, ‘গতকালই গরাণহাটার জঙ্গলে পচাগলা শরীর পাওয়া গেছে মনসুর মিঞা’র। মাথার আধখানা আর একখানা পা পাওয়া গেছে মাত্র…গাড়ি সারাই করে যখন জঙ্গলে গেছিল পেচ্ছাপ করতে, তখনই বোধহয়…’
ওদিকে নিতাই খুঁজছিল শামুকে। বউকে চোখে চোখে রাখে নিতাই, নতুন বিয়ের ক্ষেত্রে সেটা তেমন অস্বাভাবিক কিছু নয়। কিন্তু এক্ষেত্রে কারণটা অন্য, তার মনে একটা সন্দেহ পাকিয়ে উঠছে কয়েকদিন ধরেই।