জবাব দেয় না মনসুর মিঞা। সেই যে গাড়ি সারিয়ে টারিয়ে তারপর পাশের জঙ্গলে পেচ্ছাপ করতে গেছিল লোকটা, তারপর ফিরে আসার পর থেকেই কেমন যেন থুম মেরে গেছে সে। চোখ দুটো সামান্য লাল, কারও সঙ্গে কথা বলছে না, কাঁধ দুটো সামান্য উঁচু হয়ে আছে। সমাদ্দারের কথার জবাবে সামান্য একটা অদ্ভুত আওয়াজ করে সে। আর ঠিক সেই সময়েই একটা মাংসপচা গন্ধ যেন মাছধরা জালের মতোই ঝাঁপিয়ে পড়ল সবার ওপরে।
দরজা বন্ধ করে বসে ছিল রাখহরি সাধুখাঁ। এখন পরম ভক্ত বৈষ্ণব হলে কী হবে, এককালে তার নাম করে বাচ্চাদের ঘুম পাড়ানো হতো আশেপাশের গাঁয়ে, এমনই প্রতাপ ছিল তার। একখানা লাঠিগাছ সম্বল করে চার চারটে পাঠানকে ঘায়েল করার গল্প এখনও আশপাশের পাঁচ গাঁয়ের লোকে বলাবলি করে। চিরকালই তার ভয়ডর কম, বুকে দুর্জয় সাহস। যখন বলি দেওয়ার চল ছিল, তখন খোঁড়া ভৈরবীর সামনে এক কোপে জোড়া মোষের গলা নামাত রাখহরি। লোকে এখনও নীচু গলায় বলাবলি করে এককালে যারা রাখহরি’র হাতে বলি হয়েছে তাদের সবাই চারপেয়ে নয়। এহেন ডাকসাইটে রাখহরি নবদ্বীপের রাসের মেলায় ঘুরতে গিয়ে মদনমোহন গোস্বামীর কাছে দীক্ষা নিয়ে ফেলে এখন বিলকুল শুধরে গেছে। দু’বেলাই নিরামিষ খায়, একাদশীতে হবিষ্যি করে, পূর্ণিমা অমাবস্যায় তার বরাদ্দ শুধু ফলাহার আর সাবু।
সেই দিন ঠাকুরের নামগান করার জন্যে কত্তালটা নিয়ে বসেছে রাখহরি, ভক্তিগীতি লহরীতে ডুবে গেছে সে, ‘গুরু, তোমার চরণ পাব বলে রে’ দিয়ে শুরু, শেষতক ‘গুরুদেবো দয়া করো দীনজনে’ গাইছে, ভক্তিবিনত চোখদুটি থেকে অবিরল নেমে আসছে প্রেমাশ্রুধারা, এমন সময় বাড়ির চালে খড়খড় আওয়াজ হতে একটু অসন্তুষ্টই হয় সে। ছেলে ছোকরার দল চালকুমড়ো চুরি করতে উঠেছে নাকি? সবে দু’খান চালকুমড়ো পেকে উঠেছে, রাখহরির ইচ্ছে যে সামনের বেস্পতবার পূর্ণিমা, সেইদিন বড়ি দিয়ে চালকুমড়োর তরকারি আর অন্যান্য পঞ্চব্যঞ্জনে রাধাকৃষ্ণের ভোগ দেবে সে, শেষ পাতে একটু দই, সঙ্গে মালপোয়া। আহা মহাপ্রভু বড় ভালোবাসতেন। নষ্টচন্দ্রের দল সেসবও করতে দেবে না?
লুঙ্গিটা দু’ভাঁজ করে কোমরে গুঁজে উঠোনে নেমে আসে রাখহরি। হাতে একটা নিভু নিভু টর্চ, ব্যাটারি শেষ হয়ে এসেছে তার। চালের দিকে চেয়ে একটা হাঁকার দেয়, ‘কে রে ওখানে?’
জবাব আসার বদলে একটা শব্দ ভেসে আসে তার কানে, চালের ওপার থেকে কী যেন একটা খড়মড় করে ওদিকের চাল বেয়ে নেমে যায়।
হালকা পায়ে একটু দ্রুতই ওদিকে দৌড়ে যায় রাখহরি। ঠাকুরের ভোগের সামগ্রী যায় যাক, কিন্তু রাখহরি সাঁপুইয়ের বাড়ি থেকে কিছু একটা চুরি করে ভেগে যাওয়ার মতো চোর যে এই জেলাতে এখনও আছে সেটা ভেবেই আশ্চর্য হচ্ছিল সে।
বাড়ির পেছন দিকে যেতেই একটা মাংসপচা গন্ধ যেন ভেজানো গামছার মতোই দমবন্ধ করা ভাব নিয়ে তার মুখ-চোখের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। এখানে এই গন্ধটা এল কোত্থেকে?
হঠাৎ করেই থমকে গেল রাখহরি, তার ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় বলছিল যে এখানে কিছু একটা আছে যেটা তার বোধবুদ্ধির বাইরে। এক মুহূর্তে সমস্ত স্নায়ু সতর্ক হয়ে উঠল তার, নীচু হয়ে একটু আড়াল হল সে। নিজের অজান্তেই হাতের তালু ঘেমে যাচ্ছিল তার, তলপেটটা খালি খালি লাগছিল এককালে ডাকাতে কালীর সামনে মানুষ বলি দেওয়া রাখহরি সাধুখাঁর। ঘাড়ের রোঁয়া দাঁড়িয়ে পড়ছিল তার।
বাড়ির পেছন দিকে সামান্য ঝোপজঙ্গল হয়ে আছে। এককালে এসব নিয়মিতভাবে সাফসুতরো রাখত রাখহরি। আজকাল তারকব্রহ্ম নামগানে তার এত সময় যায় যে এসব দিকে মন দেওয়ার সময়ই পায় না সে…
ভাবতে ভাবতেই আমগাছটার গোড়ার দিকে নজর পড়ে তার, ওটা কী ওখানে? একগাদা কালো ছায়া জড়ো হয়ে আছে কেন ওখানে? আর জ্বলজ্বলে ওই আগুনে দুটো কী? কারও চোখ?
খোঁড়া ভৈরবীর মাঠের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় মনসুর মিঞার ভ্যানোটা যেন হঠাৎ করেই ফের একটা হেঁচকি তুলে থেমে যায়। সবার আগে লাফ দিয়ে নামেন কার্তিক সমাদ্দার, ‘হালায় কিয়ের ভ্যান লইয়া বাইরাও তুমি? থাইক্যা থাইক্যা থাইম্যা যায়? মশকরা করো তুমি পেসেঞ্জার লইয়্যা, মশকরা?’ আরও কিছু বলতে যাচ্ছিলেন সমাদ্দারমশাই, কাঁপা কাঁপা হাতে তার মুখটা চেপে ধরে সুবল। একটু অবাক হয়েই পাশে তাকান সমাদ্দার মশাই, জগন্নাথ বাচ্চা ছেলে, সে তখন গোকুলকে জড়িয়ে ধরে ঠকঠক করে কাঁপছে।
আকাশে পঞ্চমীর বাঁকা চাঁদ, তার ম্লান আলোয় বাঁশবনের ছায়া পড়েছে রাস্তার ওপর, সেই আলোয় কার্তিক সমাদ্দার দেখলেন যে মনসুর মিঞা ভেবে যার গাড়িতে এতক্ষণ চড়ে এসেছেন, তার কাঁধ দুটো আরও উঁচু হয়ে উঠেছে, শরীরটা দুনো হয়ে উঠেছে, হাতদুটো বেড়ে গেছে প্রায় দেড়গুণ, মুখের দুপাশ দিয়ে বেরিয়ে এসেছে দুটো কুকুরে দাঁত, আর একটা পচা গন্ধে তাঁদের বমি উঠে আসবার জোগাড়!
এইবার আস্তে আস্তে বাঁ-দিকে ঘাড়টা ঘোরালো সেই প্রাণীটা। না, ভুল হল, শুধু ঘাড়টা ঘুরল তার, আর হাত দুটো কাঁধ থেকেই যেন উলটে গেল। টকটকে লাল চোখ দুটো দিয়ে একবার যেন প্রাণভয়ে ভীত কয়েকটা লোককে দেখে নিল সে। তারপর সামনের লোকটাকে বাঁ-হাত দিয়ে খপ করে ধরে মাটির উপরে আধহাত তুলে খানিকক্ষণ দেখল, তারপর যেভাবে বাচ্চারা খেলনা পুতুলের মাথাটা খুলে ফেলে, ঠিক সেভাবেই ডানহাতটা দিয়ে তার মুণ্ডুটা ছিঁড়ে আনল একটানে।