এইখানে এসে এবার সন্দীপন ওরফে স্যাণ্ডি সামান্য কাশতে বাধ্য হলো। যার মানে হচ্ছে, ‘পিসি, গাড়ি বেলাইন হয়ে যাচ্ছে কিন্তু, ফিরে এসো, ফিরে এসো।’
পিসি খানিকক্ষণ ভুরুটুরু কুঁচকে স্যান্ডির দিকে তাকিয়ে রইলেন। মানতেই হবে ছোকরা বড়ই ডেয়ারডেভিল, কথা না বাড়িয়ে একটা সাদা পান (অল্প কিমাম আর চমন বাহার দিয়ে) বাড়িয়ে ধরল পিসির দিকে। কারণ পুরো সল্টলেক জানে যে দীপুপিসিকে ঠান্ডা করতে হলে বিজে মার্কেটের দুখনিয়া দুসাদের নিজের হাতে বানানো স্পেশাল পানের জুড়ি নেই। সেই দেবভোগ্য পান মুখে দিয়ে পিসি যে কিঞ্চিৎ প্রসন্ন হলেন সেটা পিসির মুখ দেখেই বোঝা গেল। খানিকক্ষণ খলরবলর করে পানটা চিবিয়ে পিসি বললেন, ‘আহা, কলকাতা ছেড়ে গেলে একমাত্র এই লাক্সারিটাই আমি মিস করি খুব, বুইলি! তাপ্পর শোন।’
‘মহুয়ারা এক ভাই এক বোন। মহুয়াই বয়সে বড়। ভাইয়ের নাম ছিল দীপাঞ্জন, লম্বামতো দোহারা চেহারা, খুব ভালো ফুটবল খেলত। পড়াশুনোতেও তুখোড় ছিল ছোকরা, পরে জয়েন্ট দিয়ে শিবপুরে মেকানিকালে চান্স পায়। সে যাই হোক, বিশ্বনাথকাকুরা অনেক দিন থেকেই ওখানকার বাসিন্দা। সম্পন্ন বনেদী ফ্যামিলি, সে এলাকায় চৌধুরীদের বাড়ি বলতে লোকে একডাকে চিনত। সে বাড়ির বয়েস তখনই একশোর ওপরে, ওদের এক পূর্বপুরুষের তৈরি। পরে শুনেছিলাম সেই ভদ্রলোক নাকি ঝাড়খণ্ডের নাগবংশী শাহদেও রাজাদের নায়েব ছিলেন। তখন অবশ্য ঝাড়খণ্ড হয়নি, বিহারের অংশ ছিল জায়গাটা। রাজারা যে ওঁকে অসম্ভব শ্রদ্ধা করতেন সে কথা বলাই বাহুল্য। কথিত আছে যে ঝাড়খণ্ডের রাতুতে শাহদেওদের যে রয়্যাল প্যালেসটা আছে, সেটা নাকি তাঁরই তত্ত্বাবধানে তৈরি, সে হবেও বা। আমাদের গল্পটা আসলে মহুয়াকে নিয়েই, তাই ওদের ব্যাপারে একটু বিশদে বলে নিলাম।
সে যাই হোক। আমরা তো কলেজ স্ট্রিট ঘুরে, কফি হাউসে বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা মেরে দেদার আড্ডায় মজে আছি, কফি হাউস প্রায় ফাঁকা হয়ে এসেছে অথচ আমাদের যে বাড়ি যেতে হবে সে কথা খেয়ালই নেই। হুঁশ এল মহুয়ার কথাতেই, কথা বলতে বলতে একবার ঘড়িটা দেখে ধড়পড় করে উঠে পড়ে বলল, ‘অ্যায় দীপু, আটটা প্রায় বাজে যে, বাড়ি যাবি না?’
তাড়াহুড়ো করে নীচে নেমে দেখি শীতের রাতে কলেজ স্ট্রিট ফাঁকা হয়ে এসেছে, প্রায় সব দোকানের ঝাঁপই বন্ধ। টিমটিম করে কয়েকটা ল্যাম্পপোস্টের আলো জ্বলছে। আমরা তো লম্বা লম্বা পা ফেলে মহাত্মা গান্ধী রোডের মোড়ে এসে হাজির। ও মা, এসে দেখি চারিদিক শুনশান, কোত্থাও কিচ্ছুটি নেই! না একটা বাস, না ট্রাম, না রিকশা না কিচ্ছু। অত বড় রাস্তাটার দুদিকে দৃষ্টিসীমার শেষ অবধি জনমনিষ্যি তো দূর, এমনকী পশুপ্রাণী অবধি নেই! দেখে ভারি আশ্চর্য লাগল, কলকাতা শহরের বুকে সাড়ে আটটা এমন কিছু রাত না, আরেকটু উজিয়ে গেলেই ধর্মতলা আর পার্ক স্ট্রিট, যেখানে হয়তো সন্ধে সবে শুরু হয়েছে। তবে এখানে এমন শুনশান কবরস্থান মার্কা অবস্থা কেন?
উত্তরটা পেলুম একটা ঠান্ডা জোলো হাওয়া গায়ে ঝাপটা মারতে। মাথা তুলে ওপরে তাকিয়ে দেখি আকাশটা কালো সীসের মতো ভারী হয়ে আছে, ঝড়বৃষ্টি নামল বলে। তাই রাস্তাঘাট এত ফাঁকা, এইবার বুঝলাম। কিন্তু এখন কথা হচ্ছে যে শিয়ালদহ যাবো কী করে? রাস্তা বেশিদূরের নয়, কিন্তু সঙ্গে গাদাখানেক বইপত্তর আছে যে! অত ভারী ভারী বই নিয়ে এতটা হাঁটতে হবে ভেবেই যেন জ্বর এলো গায়ে!
এমন সময় হঠাৎ দেখি একটা হাতে টানা রিকশা টুংটাং করতে করতে কলেজ স্ট্রিটের মোড়ের দিক থেকে শিয়ালদা’র দিকে যাচ্ছে। দেখে খুশি হওয়ার কথা, কিন্তু…’
এতটা বলেই পিসি চুপ করে গেলেন। স্যান্ডি একবার গলা খাঁকারি দিয়ে বলল, ‘কিন্তু কী পিসি?’
পিসি ভুরু কুঁচকে কী যেন একটা ভাবছিলেন। তারপর অন্যমনস্ক গলায় বলল, ‘আমি এখনও মাঝে মাঝে ভাবি সেদিন ঠিক কী দেখেছিলাম। চোখের ভুল? উঁ হু, মা বলত আমার নাকি শকুনের চোখ, এখনও চশমা ছাড়াই বহুদূর অবধি স্পষ্ট দেখতে পাই। তখন অল্পবয়সে অত ভুল দেখব? কী জানি?’
বলে ফের শুরু করলেন, ‘কী দেখলাম জানিস? লোকটাকে দেখে আমার চকিতের জন্যে একবার মনে হল যে লোকটা যেন হঠাৎ করে আবির্ভূত হল। কথাটা আমি ঠিক বুঝিয়ে বলত পারব কি না জানি না, তবুও চেষ্টা করছি, বুঝলি? মানে ধর বাঁদিকটা পুরো ফাঁকা, দূরে দূরে এক একটা করে ল্যাম্পপোস্টের আলো টিমটিম করে জ্বলছে, তাদের আলোগুলো রাস্তার ওপরে সার্কেল তৈরি করেছে। দুটো আলোর সার্কেলের মাঝে মাঝে বেশ খানিকটা করে অন্ধকার। আমি ওদিকেই তাকিয়ে ছিলাম, সামনে পুরো ফাঁকা রাস্তা। মহুয়া কি একটা বলছিল সেটা শোনার জন্যে ঘাড়টা ডানদিকে একবার ঘুরিয়েই ফের বাঁদিকে তাকালাম। মনে হল লোকটা যেন একটু দূরের দুটো ল্যাম্পপোস্টের মাঝখানের সেই অন্ধকার জায়গাটা থেকে হঠাৎ করে বেরিয়ে এল। আমি তো অবাক? তারপর ভাবলাম সারাদিন অনেক ঘোরাঘুরি গেছে, বেজায় ক্লান্ত লাগছে, তাই হয়তো চোখে ভুলভাল দেখছি।
সে যাই হোক, মহুয়া তো লাফিয়ে উঠেছে রিকশাওয়ালাটাকে দেখে। ও চেঁচিয়ে জিজ্ঞাসা করল, ‘এই রিকশা, শিয়ালদা যায়েগা?’ শুনে রিকশাওয়ালাটা ধীরেসুস্থে রিকশা থামাল, তারপর ডানদিকে মাথাটা ঘুরিয়ে একটা অদ্ভুত ঘড়ঘড়ে গলায় বলল, ‘যায়েগা দিদি, জরুর যায়েগা।’