‘কী করে বুজব জোর ফুরিয়ে এসেচে কি না?’ ভয়ে ভয়ে প্রশ্ন করে রাখাল মণ্ডলের বউ।
ফিসফিসে হয়ে আসে ঠানদি’র গলা, ‘কালীগিরি তান্ত্রিক বলে গেছল, যে রাতে মায়ের জিভে আপনা আপনি রক্ত দেখা যাবে, জানবি যে সেইদিন থেকেই এই চণ্ডালবন্ধনের জোর শেষ। মায়ের জিভে রক্ত আসা মানে, মা বলি চাইছেন। সেই রাতেই মাটির ওপরে উঠে আসবে প্রথম হাড়।’
‘তারপর?’ রুদ্ধশ্বাসে প্রশ্ন করে নির্মলা। বাকিরাও শ্বাস বন্ধ করে শুনতে থাকে।
‘তারপর যে রামাই ডাকাতের হাড় নিয়ে তন্তর করেছিল কালীতান্ত্রিক, সে নাকি সেই রাতেই নরক থেকে জেগে উঠে ফের ফিরে আসবে তালদিঘিতে’, বলে থামেন ঠানদিদি।
‘তারপর?’ রুদ্ধশ্বাসে প্রশ্ন করে কেউ।
চুপ করে থাকেন ঠানদিদি। তারপর ফিসফিস করে বলেন, ‘সে ফিরে আসবে পিশাচ হয়ে। তারপর এক এক করে গাঁয়ের সব্বার রক্ত মাংস চুষে খাবে সেই দানো। এক একটা করে মন্তরের হাড় উঠে আসবে, আর সেই পিশাচের গায়ে দুনো বল আসবে, আরও তেজি হবে শয়তানটা।’ হাঁপাতে থাকেন ঠানদিদি। খানিকক্ষণ চুপ থেকে ফের যোগ করেন, ‘আর যেদিন শেষ হাড়টা উঠে আসবে সেদিন…’ এই বলে চুপ করে যান সেই প্রাজ্ঞ বৃদ্ধা।
‘সেদিন কী, ঠানদি?’
‘সেদিন এই তালদিঘিতে বাপ পিতেমো’র ভিটেতে পিদিম জ্বালানোর জন্যে একটা লোকও থাকবে না রে মেয়ে,’ রহস্যময় শোনায় ঠানদি’র গলা, ‘সেই পনেরো দিনের পর নাকি এই গাঁয়ে শুধু কুকুর আর শকুন ছাড়া আর কোনও প্রাণীটির ছায়াও দেখা যাবে না।’ এই বলে চুপ করেন ঠানদিদি।
এই আলাপচারিতা শামুর সঙ্গে মন দিয়ে শুনছিলেন আরেকজনও। ডাক্তারবাবু। সব শুনেটুনে তিনি নাকের ভেতর একটা ঘোঁৎ করে শব্দ করে বললেন, ‘যত্তসব বুজরুকি আর আজগুবি গালগপ্পো, হুঁ। মেলা রাত হয়েছে, এবার আপনারা যে যার বাড়ি যান দেখি, আর এসব গল্পগাছা বলে রোগীর টেনশন বাড়িয়ে লাভ নেই। আর তুমি শোনো বউমা,’ এই বলে শামুর দিকে ফেরেন তিনি, ‘যে ক’টা ওষুধ বলে দিয়ে গেলাম টাইমে টাইমে খাইও কিন্তু। অসুবিধা হলে একটা কল দিও নিতাইকে বলে। ফোন নাম্বার তো জানোই।’ এই বলে ব্যাগ গুছিয়ে উঠে পড়েন তিনি।
ডাক্তারবাবু বেরিয়ে যাওয়ার ঘণ্টাচারেক পর ডাক্তারবাবুর খোঁজে মুখুজ্জেবাড়িতে লোক আসে, তিনি নাকি বাড়ি ফেরেননি তখনও। অনেক খোঁজাখুঁজির পর পরের দিন ভোরবেলা নাগাদ ডাক্তারবাবুর পাত্তা পাওয়া যায় কালীর মাঠের উত্তর পশ্চিম কোণে।
অবশ্য ডাক্তারবাবু নয়, ডাক্তারবাবুর বডি পাওয়া গেল বললেই ঠিক হয়।
আর তার কোমর থেকে নীচের অংশটা কে যেন খেয়ে গেছে!
‘ও হে গোকুল, আছো নাকি?’
‘আছি কাকা, সুবল কই?’
‘এই তো আমার বাঁ-পাশে। কই হে জগন্নাথ, সাড়াশব্দ নাই কেন?’
‘আছি ঠাকুর। কুয়াশায় আশেপাশে কিছু ঠাওর হয় না যে।’
‘হাঁকার দিতে থাকো হে, এর ওর নাম ধরে ডাকতে থাকো। ও মনসুর মিঞা, বলি গাড়িই চালাবে না দুটো কথাও বলবে?’
জবাব দেয় না মনসুর মিঞা, একমনে গাড়ি চালাতে থাকে। চারিদিকের যা আবহাওয়া, তাতে এই গোপপে লোকটাও থুম মেরে গেছে মনে হয়।
মাচান গোপীনাথের হাট থেকে ফিরছিল ওরা জনা ছয়েক লোক। বেরিয়ে পড়েছিল অবশ্য বেলা থাকতে থাকতেই। কিন্তু গরাণহাটার মোড়ে মনসুর মিঞার ভ্যানটা বেগড়বাঁই করতে চোখে অন্ধকার দেখে ওরা। আর অন্ধকার দেখার যথেষ্ট কারণও ছিল।
যেদিন সকালে ডাক্তারবাবুর আধখাওয়া শরীরটা পাওয়া যায়, সেই দিনই রাতে একটা অদ্ভুত আওয়াজে দাসপাড়ার মালতীর ঘুমটা ভেঙে গেছিল হঠাৎ করেই। খানিকক্ষণ কান পেতে রাখার পর তার ঠাহর হয় যে আওয়াজটা আসছে সেটা তাদের গোয়ালঘর থেকে। এদিককার গাঁয়েগঞ্জে হামেশাই রাতবিরেতে বুড়ো ভাম বা বনবিড়াল হানা দেয়, অথবা সাপখোপও হতে পারে। মোটমাট গোয়ালঘরে কিছু তো একটা ঢুকেছেই, এই ভেবে ঘরের কোণে রাখা খেটো বাঁশের টুকরোটা এক হাতে আর কেরোসিনের কুপিটা অন্য হাতে ধরে গোয়ালঘরের দিকে রওনা দেয় সে।
পরের দিন শুধু চুটকি পরা পায়ের আঙুল আর কয়েকটা হাড়গোড় পাওয়া গেছিল মালতীর, বাঁশবনের দক্ষিণ কোণে।
সেইদিন থেকেই লোকজনের মনে ভয়টা পাকাপোক্ত ভাবে গেড়ে বসতে থাকে। সত্যি সত্যি রামাই ডাকাত ফিরে এল নাকি পিশাচ হয়ে?
‘কথা কও না ক্যান মিঞা’, এইবার হাল ধরেন কার্তিক সমাদ্দার। সম্পন্ন ব্যবসায়ী, পাঁচটা সর্ষের তেলের মিল আছে আশেপাশের গঞ্জে, তার মধ্যে একটা আবার মাচান গোপীনাথের হাটে। তাগাদায় বেরিয়েছিলেন সমাদ্দার মশাই। নিজের অ্যাম্বাসাডারটা মাঝরাস্তায় জবাব দেওয়াতে নেহাত বাধ্য হয়েই এই ভ্যানোতে চড়তে হয়েছিল তাঁকে। এতক্ষণ ধরে মনে মনে ইষ্টনাম জপ করছিলেন তিনি। একে রাত বিরেতে বাইরে থাকা তাঁর সখত না পসন্দ, তার ওপর আজকাল গাঁয়ে যা চলছে তাতে সোয়াস্তিতে থাকার কথাও নয়। চারিদিকের এই এর-ওর নাম ধরে ডাকার মানেও ভালোই বুঝছিলেন সমাদ্দারমশাই, মনের জোর বজায় রাখা আর কি!
‘ও মিঞা, কাল বাজারে তোমার পোলাডার লগে কথা হইল গিয়া, বোঝলা? ছ্যামড়ার কথাগুলান ভারি মিষ্ট, সহবত শিখসে খুব। ওরে টোটো চালাইতে কও ক্যান? গঞ্জের বাজারে একখান দুকান দিতে কও না পোলারে, আমি তো আসি এহনও’, সাহস যোগানোর চেষ্টা করেন কার্তিক সমাদ্দার, বোধহয় নিজেরই।