রাস্তা ছেড়ে সন্তর্পণে বাঁশবাগানে ঢুকল দনু, বুকটা দুরুদুরু করছিল তার। একটু এগিয়েও থমকে গেল সে।
কারণ সে স্পষ্ট দেখতে পেল যে গরুটা আসলে বসে নেই, শুয়ে আছে। আর যেভাবে ঘাড় কাত করে শুয়ে আছে তাতে বোঝা যায় যে তার গলাটা মুচড়ে দিয়েছে কেউ। একটা হাড় চিবোনোর মড়মড় আওয়াজ কানে এল নাকি তার?
আর মরা গরুটার পাশে কালো ছায়ার মতো কে ওটা? জ্বলজ্বলে চোখ?
ঠিক এই সময়েই মেঘ সরে গিয়ে একটুকরো চাঁদের আলো যেন বজ্রপাতের মতোই আছড়ে পড়ল তার গায়ে।
তারপর আর কিছু মনে নেই দনুর।
বাথরুমে ঢুকে বেসিন ধরে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে ছিল শামু, মানে এ বাড়ির নতুন বউ শাম্ভবী। বাথরুমে বউয়ের জন্যে একটা বাহারি ওয়াশ বেসিন বসিয়ে দিয়েছে নিতাই, তার ওপরে একটা ছোট আয়নাও লাগিয়ে দিয়েছে। ঝটপট মুখেচোখে জল দিয়ে উত্তেজনাটা কমাবার চেষ্টা করছিল শামু। হাতে লেগে থাকা শাশুড়ি মায়ের রক্তটা শুধু একবার জিভের ডগায় ঠেকায় সে, আহ, কী স্বাদ!
বাথরুমের বাইরে থেকে দরজায় টোকা দেয় পিসতুতো ননদ শ্যামলী, ‘ও বৌদি, একবারটি এসো না। ডাক্তারবাবু কী সব বলবেন বলে ডাকছেন তোমাকে।’ শুনেই যতদূর সম্ভব গলার স্বর স্বাভাবিক করে ফেলে শামু, তারপর উত্তর দেয়, ‘যাই।’ দ্রুত গামছা দিয়ে মুখটা মুছে ফেলে সে।
বাসন্তীপিসি চোখ বন্ধ করে চুপচাপ শুয়ে ছিলেন বিছানায়। মাথায় মস্ত বড় ব্যান্ডেজ, পড়ে গিয়ে অনেকটা কেটে গেছে মাথায়। পাশে ভিড় করে আছেন গ্রামের ছোটবড় গিন্নিদের দল।
ডাক্তারবাবু গম্ভীরমুখে প্রেশার মাপছিলেন বাসন্তীপিসির। আশেপাশের মহিলাদের মুখে উদ্বেগ ছাপিয়েও যেটা ফুটে উঠছিল সেটার নাম ভয়, হাড় কাঁপানো ভয়!
‘সত্যি দেখেচিস তুই?’ সামন্তদের বড় গিন্নি ফিসফিস করে প্রশ্ন করেন পাশে দাঁড়িয়ে থাকা নির্মলাকে। নির্মলা হল ঘোষেদের ছোট মেয়ে।
‘হ্যাঁ গো পিসি,’ নির্মলার চাপা স্বরে উত্তেজনা ফুটে বেরোচ্ছিল, ‘পষ্ট দেখলুম মায়ের জিভটা লাল, টকটকে লাল। অক্ত গড়িয়ে পড়ছে যেন।’
বাকিরা শিউরে উঠলেন সে কথা শুনে, জোড়হাত কপালে ঠেকালেন কেউ কেউ। এর মধ্যেই ক্ষীণ প্রতিবাদ করার চেষ্টা করে সরকারদের বড় বউ টুম্পা, ‘ধুর, কি দেখতে কি দেখেছে, ও বাচ্চা মেয়ে…।’
‘অ, আমি বলে বাচ্চা মেয়ে।’ ক্ষোভে ফেটে পড়ে নির্মলা, ‘আর ঠাউরমশাই দেকলো, ন’পাড়ার দোক্তাদিদা দেকলো, নারানদের বড় জ্যেঠা দেকলো, বাচ্চুকাকু দেকলো, সেগুনো কিচু নয়, না?’
অকাট্য যুক্তির সামনে চুপ করে যায় টুম্পা। কান খাড়া করে এই কথোপকথন শুনছিল শামু আর ক্রমশই তার কৌতূহল চাগাড় দিয়ে উঠছিল। শাশুড়িমা’কে ধরাধরি করে বাড়িতে নিয়ে আসা ইস্তক একটা ফিসফিস চলছে, খেয়াল করেছে সে। নিতাইয়ের মুখটাও গম্ভীর, বাইরের বৈঠকখানায় শ্বশুরমশাই আর গাঁয়ের গণ্যমান্য লোকেরা বসে মিটিং করছেন। খুব সাঙ্ঘাতিক কিছু ঘটেছে নাকি? প্রবল কৌতূহলে উশখুশ করছিল সে, অথচ নতুন বউয়ের পক্ষে আগ বাড়িয়ে কৌতূহল প্রকাশ করাটাও ভালো দেখায় না।
‘মায়ের জিভে রক্ত দেখলে কী হবে গো দিদি?’ প্রশ্ন করে সানাপাড়ার রাখাল মণ্ডলের বউ। বয়েস হলে কী হবে, বুদ্ধিশুদ্ধিতে মহিলাকে প্রায় নাবালিকা বললেই চলে।
‘সে কী রে বউ, কালীগিরি তান্ত্রিকের ওই গেরামবন্ধনের কতা শুনিসনি তুই?’ অবাক বিস্ময়ে প্রশ্ন করেন সামন্তগিন্নি, ‘কালীগিরি তান্ত্রিক যে বলে গেসল, খুঁতো ভৈরবীর পুজো করে যাতে গেরামের কোনও অনিষ্ট না হয়, তাই সে নাকি মন্তর দিয়ে গেরাম বেঁদে দিয়ে যাচ্ছে। যে রাতে মায়ের পিতিষ্ঠে হয়, সেই রাতেই শ্মশান থেকে এক ডোম না বাগদী কার একটা মড়া এনে, তাকে তন্তরমন্তর করে, সেই মড়ার হাতের দুটো আর পায়ের দুটো, এই চারটে হাড় গেরামের চার কোনায় পুঁতে বাঁদন দিয়ে দেয়। কিন্তু কালী তান্ত্রিক এও বলে গেসলো যে তার মন্তরের জোর থাকবে মাত্তর তিনশো বচর।’
‘তারপর?’ নির্মলা গ্রামেরই মেয়ে, এসব কথা তার কমপক্ষে একশোবার শোনা। তবুও ব্যাপারটা আরেকবার ঝালিয়ে নেওয়ার জন্য প্রশ্ন করে সে, ‘তারপর কী হবে?’
‘তারপর কী হবে জানতে চাইছিস মেয়ে?’ থুত্থুরে গলায় বলে ওঠেন এক বৃদ্ধা, এতক্ষণ এক কোনায় একটা মোড়াতে নির্জীব হয়ে বসেছিলেন তিনি।
কান থেকে প্রেশার মাপার যন্ত্র খুলে শামু’র দিকে চাইলেন বর্ষীয়ান ডাক্তারবাবুটি। চিন্তিতস্বরে বললেন, ‘প্রেশারটা অ্যাবনর্মালি ফল করে গেছে বুঝলে, কোনও একটা সাডন শক থেকে এরকম হয় মাঝেমাঝে। মাথার কনককশনটাই চিন্তায় ফেলেছে যদিও। হপ্তাদুয়েকের কমপ্লিট বেড রেস্ট লিখে দিয়ে গেলাম, হালকা মুরগির স্টু আর দু-পিস করে সেঁকা পাঁউরুটি খাওয়াবে দুবেলাই। যা যা ওষুধ লিখে দিয়ে গেলাম আজ দুপুর থেকেই খাওয়ানো শুরু করে দিও। দুদিন অন্তর ব্যান্ডেজ পালটে ড্রেসিং করে দিতে হবে। পাঁচদিন বাদে একবার খবর দেবে অবস্থা জানিয়ে।’ এই বলে খসখস করে খবরের কাগজের ওপরে রাখা প্যাডে ওষুধ লিখতে থাকেন ডাক্তারবাবু।
‘তারপর?’ এইবার হাল ধরেন এঁদের মধ্যে যিনি বয়স্কতম, মণ্ডলদের সেই ঠানবুড়ি। যে প্রজার অসাবধানতায় তালদিঘির ভৈরবীর নাম খোঁড়াভৈরবী, তিনি এই মণ্ডলদেরই পূর্বপুরুষ। ফলে পুরো ঘটনার খুঁটিনাটি বংশপরম্পরায় তাঁর জানা, ‘ডোম বা বাগদি নয় রে মেয়ে, কালী তান্ত্রিক যার মড়া নিয়ে তুক করেছিল তার নাম ছিল রামাই, সেকালে নাকি নাম করা ডাকাত ছিল সে। তার ভয়ে এই পরগনা থরথর করে কাঁপত।’ বলে একটু দম নেন ঠানবুড়ি, তারপর ফের শুরু করেন, ‘কালীতান্ত্রিক বলে গেছিল যে, তিনশো বছর পর এই বাঁধনের জোর নাকি আস্তে আস্তে ফুরিয়ে আসতে আসতে শেষ হয়ে যাবে। তখন নাকি ঠিক এক পূর্ণিমা থেকে পরের অমাবস্যার মধ্যে ওই চারটে হাড়ই এক এক করে মাটির উপর উঠে আসবে।’ বলে চুপ করে যান ঠানদি।