কলকাতা শহর ছেড়ে এই গণ্ডগ্রামের দিকে চাকরি করতে আসার খুব একটা ইচ্ছে ছিল না দনুর। এসএসসি-র পরীক্ষাটা দিয়ে এদিকওদিক প্রাইভেট কম্পানিগুলোতে চাকরির চেষ্টাই করছিল সে। কিন্তু দু-একটা ইন্টারভিউ দিয়ে দনু দ্রুতই বুঝে যায় যে, চাকরির বাজারের হাল সে যতটা ভেবেছিল তার থেকেও খারাপ, খুব খারাপ। বউদিও এদিকে ঠারেঠোরে ঈঙ্গিত দিচ্ছিল যে দাদার সংসারে বেশিদিন গলগ্রহ হয়ে থাকলে এখনও যে ডিমটা, দুধটা জুটছে সেটা ভবিষ্যতে নাও জুটতে পারে।
ফলে বেড়ালের ভাগ্যে শিকে ছেঁড়ার মতো এই স্কুলমাস্টারির চাকরিটা পেয়ে আর দুবার ভাবেনি দনু। অ্যাপয়েন্টমেন্ট লেটার হাতে নিয়ে সে একপ্রকার স্টেশনে এসে রেলগাড়ি চেপে বসে বললেই চলে। গ্রামের একদম কোনায় সস্তায় একটা বাড়ি ভাড়াও স্কুলের পক্ষ থেকেই ঠিক করে দেওয়া হয়েছিল তাকে।
গত দুদিন গ্রামে ছিল না দনু, সপ্তাহান্তের ছুটিতে কলকাতা গেছিল দাদা বউদির সঙ্গে দেখা করতে, আর টুকটাক কিছু কেনাকাটা করতে। বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে আড্ডা মেরে দৌড়ঝাঁপ করে শেষ পর্যন্ত সে যখন স্টেশনে পৌঁছয় তখন আটটা চল্লিশের লোকাল দিয়েছে ছেড়ে। ফলে সে লাস্ট ট্রেনটাই ধরতে বাধ্য হয়।
স্টেশন থেকে টোটো ধরেছে দনু, বরাবরই যেমন ধরে। সারা স্টেশন চত্ত্বর ফাঁকা দেখেও তেমন কিছু মনে হয়নি, কিন্তু টোটোটা যখন ভেতরে ঢোকার বদলে গ্রামের বাইরেই তাকে নামিয়ে দিল তখনই খটকা’টা লাগে তার।
‘কী রে, ভেতরে যাবি না?’ বিস্মিত স্বরে প্রশ্ন করেছিল দনু।
‘না বাবু,’ চাপা স্বরে জবাব দেয় মফিজুল, ‘এখন রেতের বেলা গাঁয়ে ঢুকতে পারবুনি। আব্বু মানা করে দেছে।’
‘কেন রে?’ আরও অবাক হয়েছিল দনু, ‘আগের হপ্তাতেই তো বাড়ি অবধি ছেড়ে দিয়ে এসেছিস, আজ কী হল?’
‘সেসব বলতে পারবুনি বাবু, বলা বারণ। অ্যাই তো একটুখান রাস্তা, হাঁটি চইল্যে যান না কেন। টর্চ আনিছেন?’
বিরক্ত হয়েছিল দনু, ‘টর্চ আনব কেন? আগে যদি জানতাম আজ এসব ফালতু বাহানা মারবি তাহলে ব্যবস্থা করতাম। যত্তসব’, বলে হাঁটা দিতে যাচ্ছিল দনু, এমন সময় মফিজুল একখানা ছোট টর্চ হাতে ধরিয়ে দেয় ওর। ‘বাড়ির ভিতরি ঢুকবার আগতক টর্চ খান নেভাবেন না বাবু, আর পেছন বাগ থিকে কেউ ডাকলে খবদ্দার ফিরে তাকাইয়েন না কিন্তুক। আল্লার নাম, থুড়ি রামের নাম নিতে নিতে চইল্যে যাবেন। টর্চ খান কাল বাজার করতি আসবেন যখন, তখন সাধনের মুদিখানায় দিয়্যা দিয়েন।’ বলে আর দাঁড়ায় না মফিজুল। টোটোখানা ঘুরিয়ে সেখান থেকে প্রায় পালিয়েই যায় যেন।
রাস্তা দিয়ে আসতে আসতেই একটা পচা আঁশটে গন্ধ টের পাচ্ছিল দনু, তার সঙ্গে পাথরচাপা নৈঃশব্দ। গ্রামের রাস্তা এমনিতেই একটু নির্জন থাকে, তার ওপর শীতের রাত। কিন্তু তা সত্ত্বেও চারিদিক এত চুপচাপ কখনও দেখেনি সে। রোজই রাতে খাওয়া দাওয়ার পর একটু হাঁটতে বেরোয় দনু। তখন হাটফেরতা চাষিদের দল থাকে রাস্তায়, থাকে সাইকেলের সামনের রডে মেয়ে বসিয়ে ঘুরতে বেরোনো বখাটে ছোঁড়াদের দল। এছাড়াও শহর থেকে রাতের ট্রেনে আসা অনেকের সঙ্গেই দেখা হয়ে যায় তার।
আজ তবে সবকিছু এত চুপচাপ কেন?
দুদিন আগেই পূর্ণিমা গেছে। আকাশে দ্বিতীয়ার চাঁদ, অল্প একটু মেঘও করেছে। আবছা আলোছায়ায় সামনে পড়ে থাকা কালো ফিতের মতো সরু রাস্তাটাকে সাপের খোলসের মতো লাগছিলো দনুর। যেখানে টোটো তাকে নামিয়ে দিয়ে গেছে সেখান থেকে তার বাড়ি বেশ খানিকটা রাস্তা। যেতে যেতে খেয়াল করে সে, চারিপাশে একটুও শব্দ নেই কোথাও, মানুষজন বা নেড়ি কুকুর কারও পাত্তা নেই, এমনকী গাছের পাতা অবধি নড়ছে না! শুধু চারদিকে আলগা অভিশাপের মতো লেগে আছে কটু আঁশটে গন্ধটা। আরও কী যেন একটা নেই, ভাবছিলো দনু, তাই এত অস্বস্তি হচ্ছে আজ। একটু পরে সেটা খেয়াল করতে তার হাঁটাটা আস্তে হয়ে এল।
ঝিঁঝির ডাক। একটা ঝিঁঝিপোকাও ডাকছে না আজ।
গ্রামে আসা ইস্তক এই দুই সপ্তাহে এমন একটা রাতও যায়নি যখন এই বিপুল শব্দ ব্রহ্মতালা লাগায়নি তার কানে। আজকাল তার অনেকটা অভ্যেস হয়ে গেছে শব্দটা, তাই এই চুপচাপ থাকাটা কেমন যেন অশরীরী লাগল তার। দনুর মনে হচ্ছিল এই চুপজোছনার রাত যেন ভারী পাথরের মতো তার বুকে চেপে বসেছে।
শীতের রাতেও একটু ঘেমে উঠছিল দনু, হাঁটার বেগটা বাড়িয়ে দিল সে। সামনের তেমাথার মোড় থেকে একটা রাস্তা বেঁকে গেছে ডানদিকে। সেই রাস্তা দিয়ে একটু এগোলেই গ্রামের পাশের বড় বাঁশবনটা। তার গা দিয়ে একটা শর্টকাট আছে দনুর বাড়ির দিকে যাওয়ার। রাস্তাটা খোঁড়াভৈরবীর মাঠের ধার ঘেঁষে। সেই রাস্তাটাই ধরল দনু, তাড়াতাড়ি হবে। আর এক মুহূর্তও খোলা জায়গায় থাকতে চাইছিল না সে।
বাঁশবনের মাঝামাঝি যেই এসেছে সে, সেই পচাটে গন্ধটা যেন হঠাৎ করে বেড়ে উঠে একঝলক দমকা হাওয়ার মতোই ঝাপটে গেল তার চোখেমুখে। প্যান্টের পকেট থেকে রুমালটা বার করে নাকে দিতে যাবে দনু, এমন সময় বাঁদিকে কী যেন একটা আওয়াজ শুনতে পেয়ে দাঁড়িয়ে গেল সে।
ঝোপের আড়ালে কী ওটা? ওই যে নড়াচড়া করছে? মাথা নীচু করে হাতের পাতাটা কপালের ওপর ধরে ঠাহর করার চেষ্টা করল সে, মুরলীদের বাড়ির কেলে গাইটা না? এখানে বসে আছে কেন এত রাতে? গোয়ালে নিয়ে যায়নি কেউ?