আজ পূর্ণিমা, আকাশজুড়ে মস্ত বোগিথালার মতো চাঁদ উঠেছে। হেমন্তের বাতাসে বেশ শিরশির একটা ভাব। গ্রামের শেষে যোগেন চাকলাদারের বাড়ি, তারপরেই কালীর মাঠ, আর মাঠের পাশেই ভুষুণ্ডিকাকের আমলের বড় বটগাছটার নীচে এই ভৈরবকালীর মন্দির। তালদিঘির ভৈরবীকালীর সুনাম আছে ভারি জাগ্রত দেবী বলে, দূরদূরান্ত থেকে লোকে পুজো দিতে আসে। আর আসবে নাই বা কেন? এই মন্দির নিয়ে বেশ ভয়ধরানো কাহিনিও আছে যে একটা।
লোকে বলে এ মন্দির নাকি তিনশো বছরের ওপর পুরোনো, মুর্শিদকুলি খাঁয়ের খাজাঞ্চি রায়রায়ান রামভূষণ দে সরকারের আদেশে বানানো। কামাখ্যা থেকে বিখ্যাত অঘোরী সাধক কালীগিরি তান্ত্রিককে আনা হয়েছিল মায়ের মূর্তি প্রতিষ্ঠার জন্য।
প্রতিষ্ঠার দিন সরকার মশাইয়ের এক বিশ্বস্ত প্রজার অসাবধানতায় মায়ের ডানপায়ের বুড়ো আঙুলটা ভেঙে যায়। প্রবল প্রতাপশালী রায়রায়ান সে হতভাগাকে কাটতেই চেয়েছিলেন বটে, কিন্তু হাতের কাছে চটজলদি একটা তলোয়ার বা সড়কি খুঁজে না পেয়ে শেষমেশ অনিচ্ছার সঙ্গেই সেই প্রজাকে সড়ালে কুত্তা দিয়ে খাওয়ানোর বিধান দেন।
কিন্তু তাতে বাধ সাধেন কালীগিরি তান্ত্রিক স্বয়ং। তাতে রামভূষণ বেজায় মনঃক্ষুণ্ণ হয়েছিলেন, সচরাচর তিনি এসব ক্ষেত্রে জ্যান্ত পুঁতে দিয়ে থাকেন, কুত্তা দিয়ে খাওয়ালে কষ্টটা কিছু কম হত বলেই তাঁর ধারণা। তাছাড়া অবোলা প্রাণীগুলো পেটপুরে খেতেও পারত, সে পুণ্যটার কথাও না ভাবলে চলবে কেন? তবে তার থেকেও বড় কথা হচ্ছে যে, খুঁতো মূর্তি নাকি পুজো দিতে নেই, এই নিয়ে কিছু গাঁইগুঁই করছিলেন দে সরকার মশাই। অট্টহাসিতে সে আপত্তি উড়িয়ে দেন কালীগিরি তান্ত্রিক, ‘কাল তোর মেয়ের পায়ের একটা আঙুল কাটা পড়লে তাকে ফেলে দিয়ে নতুন মেয়ে আনতি নাকি রে?’ প্রশ্ন তুলেছিলেন তিনি। ‘মূর্তি তো শুধু সাধন ভজনের সুবিধা হবে বলে রে পাগল, যে বেটির পায়ের তলায় স্বয়ং মহাকাল শুয়ে আছেন তার কী এসে যায় রে এই সবে?’
‘কিন্তু গুরুদেব…,’ চিন্তিত প্রশ্ন তুলেছিলেন রামভূষণ, ‘এতে করে যদি সেবায়েত বা গ্রামের অমঙ্গল হয়?’
কথাটা কালীগিরি তান্ত্রিককে ভাবিয়েছিল ঠিকই। তা নইলে তিনি সেই রাতেই শ্মশান থেকে এক চণ্ডালের শব এনে তন্ত্রমতে শবসাধনায় বসবেন কেন?
কালীগিরি তান্ত্রিক শ্মশানসিদ্ধাই ছিলেন, ভোর হওয়ার আগেই লোকচক্ষুর অগোচরে সেই চণ্ডালের দুটি হাতের আর দুটি পায়ের হাড় দিয়ে মন্দির আর গ্রামের চৌদিক ঘিরে ভূমিবন্ধন করে যান তিনি। সেই থেকেই তালদিঘির কালীঠাকুর খোঁড়াভৈরবী বলেই এদিগরে প্রসিদ্ধ। তালদিঘি গ্রামের লোকে জানে যদ্দিন ভৈরবী মা আছেন, তদ্দিন মায়ের আশীর্বাদে তালদিঘির ওপর বড় কোনও অপঘাত আসতে পারে না। এক যদি না…
ভারী মন দিয়ে পুজো দিচ্ছিলেন বাসন্তীপিসি, ভক্তিতে মনটা ভরে উঠছিল তাঁর। এরকমই রসেবশে রেখো মা, এরকমই রেখো। হাত জড়ো করে মাথায় ঠেকিয়ে বিড়বিড় করছিলেন তিনি, সবই তো হল মা, এবার একটা কোলজোড়া নাতি দিও, যাওয়ার আগে যেন বংশের প্রদীপ দেখে যেতে পারি। সামনের কালীপুজোয় সোনার নথই মানত করে ফেলেন তিনি। জয়ন্তী মঙ্গলা কালী ভদ্রকালী কপালিনী…ইত্যাদি বলে টলে আরতি করার সময় প্রদীপটা যেই না ভৈরবীমূর্তির মুখের সামনে এনেছেন, সেদিকে একঝলক তাকিয়েই মুহূর্তখানিক স্তম্ভিত হয়ে রইলেন তিনি, আর তারপরই আঁ-আঁ আওয়াজ তুলে দড়াম করে পড়ে মূর্ছা গেলেন গাঁয়ের মুখুজ্জে বাড়ির দাপুটে গিন্নি বাসন্তীরানি মুখুজ্জে।
মন্দিরের সেবাইত যোগেন ভশ্চাজ্যি মশাই তখন মন্দিরের বাইরে লাল সিমেন্ট দিয়ে বাঁধানো তেলতেলে রোয়াকে বসে পুজো দিতে আসা আরও জনাকয়েক পুরুষ ও মহিলাকে কৌশিকী অমাবস্যায় মহাভৈরবীকালী পুজোর মাহাত্ম্য বোঝাচ্ছিলেন। অন্তত চারটে পুজো বা যজ্ঞ পাকড়াও করে ফেলেছিলেন প্রায়, মাস দুয়েকের জন্যে বাংলা আর চাটের বন্দোবস্ত হাতে আসি আসি করছে প্রায়, তার মধ্যেই এই!
মন্দিরের ভেতরে ছুটে যেতে দেরি হয়নি কারোরই। লোকে প্রথমে ভেবেছিল মুখুজ্জেগিন্নির ফিটের ব্যামোটা বোধহয় ফিরে এসেছে। কিন্তু গ্রামের মহিলারা যখন মুখুজ্জেগিন্নির বিশাল শরীরখানি ঘিরে জলের ছিটে আর হাওয়া দিতে ব্যস্ত, তখন যোগেন ভশ্চায্যি কাঁপতে কাঁপতে ভৈরবীমূর্তির দিকে ডান হাতের তর্জনী তুলে, ‘এ কী, এ কী করে হল! এ যে মহা সর্বনাশ, মায়ের কোপদৃষ্টি জেগেছে রে!’ বলে দড়াম করে পড়ে যেতে লোকজনের মনে হয় যে ব্যাপারটা অন্যকিছু হলেও হতে পারে।
তখন সমবেত লোকেদের নজর ঘুরে যায় মূর্তির দিকে। আর তারপরেই লোকজন ভয়ে আর আতঙ্কে একেবারে কাঠ হয়ে যায়।
সেই রাতেই প্রবল ঝড় ধেয়ে আসে তালদিঘির ওপরে আর খোঁড়াভৈরবীর মাঠের উত্তরদিকের প্রাচীন বটগাছটা উপড়ে পড়ে যায়। কেউ যদি সেই গাছের গুঁড়ির দিকের মাটি আর শিকড় সরিয়ে দেখত, একটা ঝুরঝুরে উরুর হাড় তার নজর এড়াতো না নিশ্চয়ই!
গ্রামে ঢোকার সময়েই একটা কিছু টের পাচ্ছিল দনু, ওরফে দনুজদমন সেনাপতি। হপ্তা দুয়েক হল এখানেই তালদিঘি উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যায়তনের সায়েন্সের টিচার হিসেবে জয়েন করেছে সে।