জঙ্গলের ধারে একটা টিলার ওপর দাঁড়িয়েছিল লোকটা। ভোরের বাতাসে সামান্য কাঁপছিল তার দেহ। সামনে ক্ষীণতোয়া কাঁসাই নদীর বুকে লেগেছে পূব দিগন্তে সদ্য জেগে ওঠা অল্প লাল আভার রং। সেইদিকে নিষ্পলকে তাকিয়ে ছিল সে।
ব্যর্থ হয়েছে সে। তার দেওয়া অব্যর্থ অভিশাপ-বিষ আজ ব্যর্থ হয়ে গেছে, সত্যি হয়েছে ডানবুড়িদের কথাই। তারই রক্ত এসে আজ নিষ্ফল করে দিয়েছে তার এতদিনের জমিয়ে রাখা ক্রোধ, ধুলোয় মিশে গেছে তার উগরে দেওয়া ঘৃণা। যার জন্যে দেড়শো বছর ধরে এই ছাইয়ের দেহ নিয়ে, বুকে প্রতিশোধের আগুন জ্বালিয়ে ঘুরে বেড়িয়েছে সে। আজ আর তার কোনও মূল্য নেই, ব্যর্থ তার এতদিনের প্রেতদেহ ধারণ, ব্যর্থ তার সমস্ত সাধন।
কিন্তু কই, তবু তার বুকে ঝলসে ওঠে কই ব্যর্থতার তীব্র জ্বালা? তার চোখে আজ এত জল কেন? এই ছাইয়ের মানুষের চোখে এত জল আসে কোথা থেকে? কই তার বুকের মধ্যে দেড়শো বছর ধরে জ্বালিয়ে রাখা প্রতিশোধের আগুন? সেখানে আজ কেন থই-থই করে অযোধ্যা পাহাড়ের শতঝরনার জল? এত ভালোবাসা কোথা থেকে জুড়ে বসল তার অলৌকিক শরীরে? এত মায়া কী করে বাসা বাঁধে তার অন্ধ দু’চোখের কোটরে?
আকাশের দিকে দুটো হাত প্রার্থনার ভঙ্গিতে তুলে ধরে সে, ঠাকুর শুনেছিলেন তার কথা। রূপাই মরে নাই, মরে নাই। বেঁচে ছিল, বেঁচে ছিল তার কলজেছেঁড়া ধন। আজ নিজের চোখে দেখে এসেছে সে, দু’চোখ ভরে দেখে এসেছে তার রক্তের উত্তরাধিকারীকে। আহা একটিবার যদি তার মুখখানি ধরে চুমো খেতে পারত সে। আয় রে আমার রূপাই, আয় রে আমার লখাই…তোরা আয় আয় আয়…
নিভে যাওয়া অন্ধ চোখ থেকে নোনতা জল বেরিয়ে এসে ভিজিয়ে দেয় সেই ছাইপোড়া বুক। আহ, বুকের মধ্যিখানে বড় ঠান্ডা, বড় শীতল লাগে তার। দু-হাত তুলে প্রার্থনা করে সে, হো ঠাকুর, আমার্যে রূপাইয়ের কোল্যে ফির্যে দাও ঠাকুর, গোড় লাগি তর প্যাঁয়্যে।
আস্তে আস্তে তার মাথা থেকে উড়ে যেতে থাকে সেই ছাইয়ের কণা, প্রথমে ধীরে, তারপর দ্রুত। ভোরের আকাশে উড়ে যেতে থাকে তার ক্রোধ আর অভিমান, উড়ে যেতে থাকে তার পাপ ও পুণ্য, উড়ে যেতে থাকে তার ক্ষোভ আর ঘৃণা।
দাঁড়িয়ে থাকে লোকটা, আর আস্তে আস্তে জঙ্গলের মানুষের দেহের শেষ কণাটুকু মিশে যায় জঙ্গলের শীতল বাতাসে, মিশে যায় অগণন নক্ষত্রমালায়, মিশে যায় অনন্ত নীহারিকাপুঞ্জে।
ভোরের শীতল বাতাসে কে যেন ফিসফিস করে বলে যায়, বুকে বড় মায়া হে, বড় মায়া!
খোঁড়া ভৈরবীর মাঠ
[গ্রাম বাংলার আর পাঁচটা মন্দিরের মতােই এক ভৈরবী মন্দির। তফাতের মধ্যে দেবীমুর্তিটির পায়ের একটা আঙুল ভাঙা। খুঁতাে হওয়া সত্ত্বেও বিশেষ কারণে সেই মূর্তিই স্থাপন হয়েছিল গ্রামের কল্যাণার্থে। হঠাৎ একদিন সেই প্রাচীন ভক্তি-বিশ্বাসের আশ্রয়স্থলে ঘনিয়ে এল অশনি সংকেত। কার রক্ত দেবীর গায়ে ? কেন পরপর মারা পড়ছে গ্রামের বাসিন্দারা? রাতে ফেরার পথে পথিকদের উপর কিসের বিপদ ঘনিয়ে আসে এই মন্দির সংলগ্ন মাঠে? কে এই বিস্রস্ত-আঁচল অস্ত্রধারিণী—সে-ই কি পা টেনে টেনে হেঁটে ফিরছে শিকারের সন্ধানে ?…প্রতি পদে গায়ে কাঁটা দেওয়া রুদ্ধশ্বাস কাহিনি খোঁড়া ভৈরবীর মাঠ।]
কৈফিয়ত
‘খোঁড়া ভৈরবীর মাঠ’ উপন্যাস নয়, উপন্যাসিকা বলা যেতে পারে। কর্মসূত্রে আমাকে পূর্বভারতের বিভিন্ন গ্রামেগঞ্জে ঘুরে বেড়াতে হয়। সেভাবেই বিহারের এক প্রত্যন্ত গ্রামে একটি পরিত্যক্ত মন্দির দেখে আমার কৌতূহল জেগেছিল। তার পিছনের জনশ্রুতি শুনে গড়ে তুলেছিলাম ‘খোঁড়া ভৈরবীর মাঠ’-এর কাহিনি। দেব সাহিত্য কুটিরের কর্ণধার শ্রদ্ধেয়া রূপা মজুমদার নবকল্লোলের ২০১৮-র পৌষালী সংখ্যায় এটিকে স্থান দেন। তাঁর কাছে আমার কৃতজ্ঞতার শেষ নেই।
কৃতজ্ঞতা জানাই বন্ধু ও সুহৃদ মৌপিয়ালি দে সরকার এবং অনুষ্টুপ শেঠকে। এই দুজনে আমার প্রায় সব লেখার প্রথম পাঠিকা, এবং সবচেয়ে বড় সমালোচকও বটে। কৃতজ্ঞতা রইল বন্ধুবর অর্ক পৈতণ্ডীর প্রতি, এক অখ্যাত কলমচির লেখা পূজাবার্ষিকীতে স্থান দেওয়ার জন্য। কৃতজ্ঞতা জানাই আমার পাঠক ও পাঠিকাদের। তাঁরাই আমার সবচেয়ে বড় অনুপ্রেরণা।
অভীক সরকার
রথযাত্রা ১৪২৬
কলকাতা
.
খোঁড়া ভৈরবীর মাঠ
ঠিক সন্ধেটা লাগার মুখে গ্রামের খোঁড়াভৈরবী মন্দিরে পুজো দিতে এসেছিলেন মুখুজ্জে বাড়ির বাসন্তীপিসি। পিসির বয়েস পঞ্চাশের কাছাকাছি, স্বামী সন্তান নিয়ে সুখের সংসার। পৃথুল ও মেদবহুল মুখে ঘামতেলের মতো একটা আলগা তৃপ্তির জেল্লা সবসময়ই লেগে থাকে। নিত্যই মায়ের থানে পুজো দিতে আসেন তিনি, শনি আর মঙ্গলবারে ঘটাটা একটু বেশিই হয়। তা হয় হোক, এই ভৈরবীমায়ের কৃপাতেই তো গঞ্জের বাজারে এত বড় চালকল আর দু’দুখানা অয়েলমিল চলছে ওদের।
কর্তা কাজকম্ম থেকে অবসর নিয়েছেন বছরখানেক হল, এখন সবকিছু ছেলে নিতাই সামলায়। চালাকচতুর ছেলে নিতাই, এই তো মাস খানেক হল তার বিয়েও দিয়েছেন পিসি, মেয়ে বর্ধমানের, পালটি ঘর। ভারি লক্ষ্মীমন্ত বউমা পেয়েছেন বাসন্তীপিসি। সেদিন তো সামন্তগিন্নি গ্রামের গিন্নিদের মজলিশে সবার সামনে বলেই দিলেন, ‘মুখুজ্জেগিন্নির কপাল আছে গো, ভারি ভাগ্যি করে বউ পেয়েছে। ডিগ্রিপাশ হলে কী হবে, বউয়ের স্বভাবচরিত্তির যেমন ঠান্ডা, তেমন কাজকর্মেও ভারি চটপটে,’ শুনে বুকে বাতাস লেগেছিল বাসন্তীপিসির। আহা, সুখ যেন ভিয়েনে বসানো কড়াইয়ের দুধের মতো উথলে উথলে পড়ছে। দু-হাত জড়ো করে নমো করলেন বাসন্তীপিসি, ‘মা মাগো, রক্ষে করো মা। তুমিই সব।’