খেয়াল করলাম যে সেই মুখে একটা সর্বগ্রাসী ক্ষুধার দৃষ্টি। বুঝতে অসুবিধা হয় না, শিকারকে বাগে পেয়ে তাকে একটু একটু করে কাটার মধ্যে যে পৈশাচিক আনন্দ আছে, লোকটার মুখেচোখে খেলা করে বেড়াচ্ছে সেই নারকীয় উল্লাস।
আমিও কেমন যেন মোহগ্রস্ত হয়ে নির্নিমেষে চেয়ে রইলাম লোকটার মুখের দিকে।
কতক্ষণ কেটে গেছে জানি না, এমন সময় একটা জিনিস খেয়াল করে একটু আশ্চর্য লাগল। মানে তখন মনের যা অবস্থা তাতে ভয় ছাড়া অন্য অনুভূতি গ্রাহ্য হবার কথা নয়, তবুও অবাক হওয়াটাকে এড়াতে পারলাম না।
এর আগে যতবারই মুখোমুখি হয়েছি লোকটার, বরাবর দেখেছি যে ওর দৃষ্টি মহুয়ার দিকে। ঈশ্বর জানেন মহুয়ার ওপর কেনই বা ওর অত রাগ, কিন্তু প্রথম থেকেই মহুয়াই ছিল ওর ধ্যানজ্ঞানের কেন্দ্রবিন্দু।
এইবার দেখলাম, প্রথমবারের জন্যে দেখলাম, যে লোকটা কিন্তু এবার মহুয়ার দিকে তাকিয়ে নেই। তার দৃষ্টি অন্য আরেকজনের দিকে।
পিটার।
ততক্ষণে ভয়ে আতঙ্কে পাগল হয়ে যাওয়া মাথায় ব্যাপারটা বুঝতে পারলাম না স্বাভাবিক কারণেই। শুধু এইটা বুঝলাম, যে দৃষ্টিটাকে আমি ত্রু«র সর্বগ্রাসী লোভাতুর দৃষ্টি ভেবেছিলাম, সেটা আসলে অন্য দৃষ্টি। ওই দৃষ্টিতে ক্ষুধা থাকতে পারে, কিন্তু নিষ্ঠুরতা নেই। বরং অন্য একটা জ্বলজ্বলে আবেগ ফুটে উঠেছে সেই চোখে। সেটা প্রথমে ধরতে পারিনি, খানিকক্ষণ তাকিয়ে থাকার পর আমি বুঝতে পারলাম যে ওটা কীসের আবেগ।
ওটা বুভুক্ষু স্নেহাতুর হৃদয়ের দৃষ্টি। ও জিনিস মৃতপ্রায় শিকারের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা শিকারির চোখে মানায় না।
আমার সামান্য বাঁ-দিকে পিটার বসে আছে চোখ বন্ধ করে। আর আমার ডাইনে জানালার বাইরে সেই লোকটার মুখ। সামান্য ঘাড় ঘুরিয়ে দুজনকেই আমার নজরবন্দি করতে পারছি। দুদিকেই বেশ কিছুক্ষণ, মিনিটখানেকও হতে পারে, ঠিক বলতে পারবো না, তাকিয়ে থাকার পর একটা অবিশ্বাস্য জিনিস আমার নজরে এল। বারবার দেখছি ব্যাপারটা, বিশ্বাস করতে আমার মন চাইছে না। অথচ সেটা এতই জলজ্যান্ত হয়ে ফুটে উঠেছে যে নোবডি ক্যান মিস দ্যাট!’
‘অ্যান্ড হোয়াটস ওয়াজ দ্যাট?’ আমার ভূতপ্রেতে ঘোর অবিশ্বাসী বাবা জিগ্যেস করলেন ফিসফিস করে। আমরা বাকিরা তখন পটের ছবিটির মতো স্পেলবাউন্ড হয়ে বসে আছি। আমাদের সবার মুখের ওপর একঝলক তাকিয়ে নিলেন দীপুপিসি। তারপর গলাটা খাটো করে বললেন, ‘দেখলাম যে পিটার আর লোকটাকে হুবহু একইরকম দেখতে। হুবহু মানে হুবহু, এক্কেবারে কার্বন কপি বললেই চলে। শুধু লোকটার মুখে নোংরা খোঁচা খোঁচা দাড়ি, আর পিটার এক্কেবারে ক্লিন শেভড। এছাড়া দুজনের মুখের মধ্যে এতটাই মিল, যেটা অনাত্মীয় দুজন মানুষের মধ্যে হওয়া কার্যত অসম্ভব! চট করে দেখলে মনে হওয়া বিচিত্র নয় যে, এদের মধ্যে কোনও না কোনও সম্বন্ধ আছেই, মানে কোনও না কোনও রক্তের সম্বন্ধ…রক্তের সম্বন্ধ…রক্তের… রক্ত…
একটা কথা আমার নিঃসাড় মগজে যেন বিদ্যুতের চাবুকের মতো আছড়ে পড়ল।
ভৈরবীমা বলেছিলেন না, এই বিষের প্রতিষেধক শুধু সেই ছাইয়ের মানুষের রক্ত? সে কী রক্তের ফোঁটা দিয়ে তৈরি ওষুধ? নাকি অন্য কিছু?
রক্ত বলতে বংশধারাও বোঝায় না?
কথাটা ভাবতে যে কয়েকমুহূর্ত লাগল, তার মধ্যেই আমার মগজে গেঁথে গেল কথাটা, আমার সামনে যে ছেলেটা বসে আছে সে শুধু পিটার নয়, আসলে সে এই ছাইয়ের মানুষের উত্তরপুরুষ! তারই রক্ত বইছে এই পিটার হেমব্রমের দেহে। কোনও ওষুধ নয়, পিটারই আসলে এই মহৌষধের অন্যতম উপাদান। একমাত্র তার হাতে বানানো মাসানকাটাই নিরস্ত করতে পারে এই মহাশাপের বিষ।
অর্থাৎ ভৈরবীমায়ের কথাই সত্যি হল, যার অভিশাপে আজ মহুয়ার এই অবস্থা, তারই রক্ত এসে দাঁড়িয়েছে প্রতিষেধক হিসেবে। অব্যর্থতম মৃত্যুবাণের সামনে অভেদ্যতম বর্ম!
আবার তাকালাম জানলার দিকে। কেউ নেই। কিচ্ছু নেই।
দিগন্তে তখন ভোরের ক্ষীণ লালচে আভা। দিন শুরু হতে চলেছে প্রায়।
আর ঠিক সেই মুহূর্তে বিছানা থেকে একটা ক্লান্ত মৃদু আওয়াজ কানে আসায় ঘুরে বসলাম আমি। দেখি চোখ খুলে উঠে বসার চেষ্টা করছে মহুয়া, আমাকে দেখে প্রায় শোনা যায় না এমন গলায় বলল, ‘শরীরটা খুব খারাপ লাগছে রে। কিছু খেতে দিবি?
এবারের মতো শেষবারের জন্যে ওকে জড়িয়ে হাউমাউ করে কেঁদে উঠলাম আমি।’
গল্প শেষ করে চুপ করে বসেছিলেন দীপুপিসি। আমরাও নির্বাক। শুধু অরিজিৎ একবার জিজ্ঞাসা করল, ‘ওই মহাশঙ্খের মালা তোমার কাছে আছে এখনও?’
দীর্ঘশ্বাস ফেলেন দীপুপিসি।
‘পরের দিন আমরা ভৈরবীমায়ের থানে গিয়ে দেখি যে গুহা বেবাক ফাঁকা, বাঘছালটা ছাড়া সবই ফেলে গেছেন। সন্ন্যাসী মানুষ, হয়তো অন্য কোথাও গিয়ে ডেরাডাণ্ডা বেঁধেছেন। দেখে বুধনদা, মংলাদা, রেংতা, সবাই খুব আফশোস করছিল। আমি ওদের চোখ এড়িয়ে সেই গুহার মধ্যেই মালাটা রেখে আসি, ও জিনিস কাছে রাখার সাহস ছিল না আমার।
সেইদিনই বিকেলের ট্রেনে কলকাতা নিয়ে আসি মহুয়াকে। পাক্কা আড়াইমাস ভুগেছিল মেয়েটা। সেরে ওঠার পর সেই হাসিখুশি মহুয়াকে আবার ফিরে পেয়েছিলাম বটে, তবে একটা অভ্যাস চিরতরে ছেড়ে গেছিলো ওর। যেখানে সেখানে ফুচকা আর ঘুগনি খাওয়ার অভ্যেসটা।’