আমার বুকের ভেতরটা কেমন যেন বরফের মতো ঠান্ডা হয়ে এল, বুঝলি? বুঝতে পারলাম শেষ অবস্থা শুরু হয়েছে মেয়েটার, আর হয়তো কয়েকটা মিনিট। হাত নাড়াতে গিয়ে বুঝলাম যে আমার হাতেপায়ে আর সাড় নেই…
এমন সময় হঠাৎ চোখ খুলে চাইল মহুয়া। সিলিং এর দিকে চেয়ে থাকল কিছুক্ষণ, তারপর অল্প ঘাড় ঘুরিয়ে আমার দিকে হাসিমুখে তাকাল। আমি তো অবাক! একটু আগে দুজনের মধ্যে যে কুরুক্ষেত্র হয়ে গেছে তার চিহ্নমাত্র নেই। এক্কেবারে স্বাভাবিক চোখ-মুখ, মুখে মৃদু হাসির ছোঁয়া, মানে যেমন ওকে সচরাচর দেখা যায় আর কি। যেন আমাদের চিরচেনা সেই মহুয়া, এইমাত্র ঘুম থেকে উঠল। একটু পর আড়মোড়া ভেঙে উঠে, মুখহাত ধুয়ে, সেজেগুজে আমার সঙ্গে অষ্টমীতে পুজোর অঞ্জলি দিতে যাবে।
শুয়ে শুয়েই মহুয়া আমার দিকে তাকিয়ে ভারি মিষ্টিভাবে হাসল একবার। আর তারপরই স্প্রিং দেওয়া পুতুলের মতো চকিতে কোমর ভাঁজ করে, শরীরের ঊর্ধ্বাংশটা তুলে এনে আমার বাঁ-কাঁধটা দাঁত দিয়ে সজোরে কামড়ে ধরল ও, বাঁ-হাত দিয়ে চেপে ধরল আমার টুঁটি!
ব্যাপারটা এত দ্রুত ঘটল যে বুঝতে বুঝতেই আমার সময় লাগল খানিকটা। তারপর অসহ্য যন্ত্রণায় কঁকিয়ে উঠে ওকে যখন ঝটকা দিয়ে ফেলে দিয়েছি, তখনই মনে হচ্ছে আমার কাঁধের খানিকটা কে যেন খুবলে নিয়েছে। জ্বলন্ত শিক ঢুকিয়ে দেওয়ার মতো যন্ত্রণায় আমার বাঁ-দিকটা পুরো অসাড় হয়ে এল।
তারপর একটা সম্পূর্ণ অপরিচিত ভৌতিক ক্যারক্যারে পুরুষালি গলায় হি-হি হি করে হেসে উঠল মেয়েটা। তারপর তার সঙ্গে দুলে দুলে হাততালি দিতে লাগল।
গলাটা শুনে আমার ঘাড়ের সমস্ত রোম দাঁড়িয়ে গেল, বুঝলি! রাতবিরেতে চেনাজানা কোনও মেয়ের মুখে ছেলের গলায় ভূতুড়ে স্বরে খিলখিল হাসি শুনলে ভয় লাগারই কথা। কিন্তু আমার ভয় লাগার আরও একটা অন্য কারণ ছিল।
ব্ল্যাকবোর্ডের ওপরে নখের আঁচড় কাটার শব্দের মতো এই গলাটা আমার চেনা।
এ গলার স্বর আমি আগেও শুনেছি।
কলেজ স্ট্রিটের রাস্তায়। মাস দেড়েক আগে।
এটা সেই লোকটার গলা। সেই ছাইয়ের মানুষ!
পিটারের দিকে তাকিয়ে দেখি চোখ বন্ধ করে বিড়বিড় করে কী যেন উচ্চারণ করে চলেছে সে। এই শীতের রাত্রেও ঘামে ভিজে গেছে তার জামা। এদিকে মহুয়া সেই ভূতুড়ে গলায় খলখল স্বরে হাসতে হাসতে ঘরের বাতাসকে শিউরে তুলেছে। হাসতে হাসতেই হঠাৎ করে একবার হেঁচকি তুলল মহুয়া, আর তারপরেই চেপে ধরল নিজের গলাটা।
আমিও আঁতকে উঠলাম।
দেখলাম দীর্ঘ কালো নখগুলো দিয়ে ও আঁকড়ে ধরেছে নিজের গলা, চোখদুটো বড় বড় হয়ে উঠেছে। ঠিক যেন একটা ফাঁসির আসামিকে গলায় ম্যানিলা রোপ পরিয়ে সজোরে টেনে ধরেছে কেউ!
পরের দৃশ্যগুলো স্রেফ অসহায়ের মতো দাঁড়িয়ে দেখতে হল আমার। বরফের মতো ঠান্ডা হাত-পা নিয়ে দেখলাম যে মেয়েটা আঁকড়ে কামড়ে ফালাফালা করে দিচ্ছে নিজের গলা। যে অদৃশ্য পাশ সাক্ষাৎ কালসাপের মতো চেপে বসেছে ওর গলায়, সর্বস্ব পণ করে ও চেষ্টা করছে তার থেকে নিজেকে মুক্ত করতে।
আমি সভয়ে সরে এলাম, আমার ক্ষমতা নেই এই অতিলৌকিক শক্তির বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার।
এদিকে মহুয়ার অবস্থা ক্রমেই কাহিল হয়ে উঠছে। কাটা পাঁঠার মতো বিছানার ওপর পা’দুটো দাপাচ্ছে ও। মুখচোখ ফুলে নীল হয়ে এসেছে, চোখ দুটো যেন ঠেলে বেরিয়ে আসবে। রক্তাক্ত গলাটা দেখে মনে হচ্ছে যেন কোনও হিংস্র প্রাণী ঝাঁপিয়ে পড়েছিলো ওর ওপর। ডাইনির হাতের মতো কালো হাতদুটোর শিরা ফুলে উঠেছে। শ্বাসবন্ধ হওয়ার শব্দটা স্পষ্ট হয়ে উঠছে আরও। আমার হাত-পা অবশ হয়ে আসছে, আমি বুঝতে পারছি না কী করব…
এমন সময় দেখলাম দপ করে নীল আগুনের মতো জ্বলে উঠল মহুয়ার গলায় ঝোলানো সেই মহাশঙ্খের মালাটা। সাদা হাড়ের মধ্যে যেন বিদ্যুতের মতো খেলা করে যেতে লাগল ছোট ছোট নীল আলোর শিখা।
এক ভৌতিক আতঙ্কের সঙ্গে যুঝতে লাগল আরেক অপার্থিব অভয়শক্তি।
জানি না কতক্ষণ নিষ্পলক চোখে তাকিয়ে ছিলাম এই অনৈসর্গিক দৃশ্যের সামনে। একসময়ে ভেবেছিলাম বুঝি হেরেই গেলাম এই লড়াইতে। কিন্তু কিছু পরে বুঝতে পারলাম যে ধীরে হলেও আস্তে আস্তে এই যুদ্ধের ফলাফল আমাদের পক্ষে চলে আসছে। যদিও তখনও লড়ে যাচ্ছে মহুয়া, তবে বুঝতে পারছিলাম যে আস্তে আস্তে সেই অজানা ফাঁস আলগা হতে শুরু করেছে। আওয়াজ করে শ্বাস নিতে শুরু করেছে মেয়েটা। আস্তে আস্তে ছটফটানিটা কমে এল, বন্ধ হল গলা আঁচড়ানো।
তারপর একসময়ে দম শেষ হওয়া কলের পুতুলের মতো ঠাস করে বিছানার ওপর নিঃসাড়ে পড়ে গেল মেয়েটা।
ওর দিকে ছুটে যাবার আগে একবার তাকালাম পিটারের দিকে, আর ঠিক সেই সময় আমার চোখ গেল জানলায়। আর সেদিকে একবার তাকানোর পর, আমার হাত-পা ঠান্ডা হয়েই ছিল ভয়ে, এরপর একেবারে অসাড় হয়ে গেল আমার দেহ।
দেখলাম যে জানলার ওপারের জমাট অন্ধকারে জানলার গ্রিল জুড়ে আস্তে আস্তে ফুটে উঠছে একটা মুখ। বীভৎস ত্রু«র সেই মুখাবয়বে ফুটে উঠছে এক ভয়াল আদিম জিঘাংসা। এই ভয়ঙ্কর মুখটাকে আমি চিনি, খুব চিনি। আর আজকে এও জেনেছি যে এই মুখ রক্তমাংসের কোনও মানুষের মুখ নয়। এর শরীরে বাসা বেঁধে আছে প্রাচীন বিষ, এর ধমনীতে খেলা করে বেড়ায় যন্ত্রণার আগুন, এর চৈতন্য জুড়ে শুধু প্রতিশোধের উদগ্র বাসনা। এই মরপৃথিবীর বাসিন্দা নয় ও, নরকের কোন অতল থেকে উঠে এসেছে, ও ছাইয়ের মানুষ!