অর্ধেকটা খাইয়ে বাকি অর্ধেকটা পিটারের নির্দেশ মতো রেখে দিলাম।
এইসময় কানে এল স্যাঁওতালি ভাষায় উচ্চারিত কিছু মন্ত্র, সুরেলা গলায় কিছু একটা গাইছে পিটার।
ওষুধটা খাইয়ে পিটারের দিকে ফিরে বসলাম। দেখি একটা গ্লাস থেকে জল নিয়ে হাতে করে চারিদিকে ছিটোতে ছিটোতে সারা ঘরটা প্রদক্ষিণ করছে পিটার, আর সুর করে গাইছে,
‘সের চাওলে কুপি সুনুম,
লেটের আদিঞ অগমকালি মাঈ।
নিয়া জাতরা অন্ত রেণা, কাথা কাল মাঈ,
লালই দেম্না তিং।
এর পরে দেখি পিটার ঘরের কোনা থেকে তিনটে মাটির পিণ্ড এনে মেঝের মাঝখানে এমন ভাবে রাখল, যেন মনে হচ্ছে একটা ত্রিভুজের তিনটে শীর্ষবিন্দু। সেই পিণ্ডগুলোতে তিনটে শালগাছের ডাল পুঁতল তারপর, আর একটা লাল সুতো দিয়ে ডালগুলোর মাথা বাঁধল। এরপর দরজা খুলে বাইরে গেল একটু, ফিরে এল মিনিটখানেক বাদে। আর এসেই যে জিনিসটা ওই ত্রিভুজের মধ্যিখানে রাখল সেটা দেখে শিউরে উঠলাম আমি।
একটা কালো মুরগির কাটা মাথা। কাটা মাথায় রক্ত লেগে আছে এখনও।
পিটার অবশ্য আমার শিউরে ওঠাটাকে বিন্দুমাত্র আমল না দিয়ে একের পর এক বিভিন্নসব বিচিত্র দর্শন পাথরের টুকরো, নাম না জানা পশুর লোম, শুকিয়ে যাওয়া সাপের মাথা, কাকের পা আর ধানদুব্বোর সঙ্গে লাল টকটকে কয়েকটা জবাফুল, এইসব জিনিস সেই কাটা মাথাটাকে ঘিরে রাখতে লাগল। এসব শেষ হওয়ার পর অতি যত্নে আধ আঙুল লম্বা, সাদা রঙের সূচল কী একটা যেন বার করে সেই কাটা মাথাটার ওপর রাখতে আমি সন্তর্পণে জিগ্যেস করলাম, ‘কী ওটা?’
কালকেউটের বিষদাঁত। শান্তস্বরে জবাব দিল পিটার। শুনে আমার আর কিছু জিগ্যেস করতে সাহস হল না।
এরপর সেই পিণ্ডতিনটির সামনে দক্ষিণমুখী হয়ে বসে, অদ্ভুত সুরে সাঁওতালি মন্ত্র আওড়াতে লাগল পিটার। মাঝে-মাঝে হাতের মুদ্রায় বিচিত্র সব ভঙ্গি করতে লাগলো। আমি আড়চোখে মহুয়ার দিকে তাকালাম। কোনও চেঞ্জ দেখলাম না।
এমন সময় দেওয়াল ঘড়ির দিকে চোখ গেল। রাত দুটো।
ফিসফিস করে বলে উঠল পিটার, এইবার শুরু হবে।
আর বলার সঙ্গে সঙ্গে বোবা গলায় একটা আর্তনাদ করে উঠল মহুয়া। তাকিয়ে দেখি চোখ দুটো খুলে গেছে ওর, চোখের সাদা অংশটা গাঢ় হলদে হয়ে আছে, মণিদুটো হয়ে এসেছে অনেক ছোট।
আমি দৌড়ে গিয়ে জড়িয়ে ধরলাম ওকে। আর ধরতেই যেন একটা ইলেকট্রিক শক খেলাম। বাপ রে বাপ, তখন দেখি ওর গায়ে কোথা থেকে যেন দৈত্যের শক্তি ভর করেছে। ওই রুগ্ন অসুস্থ শরীরে এত আসুরিক গায়ের জোর কোথা থেকে যে এলো তা কে জানে! সারা বিছানা যেন উথালপাতাল হয়ে যেতে লাগল সেই অজানা আক্রোশে। বড় বড় চোখে, সম্পূর্ণ উন্মাদের মতো গোঁ-গোঁ আওয়াজ তুলে সে কী তাণ্ডব, বাধা পেয়ে শেষে আমাকে এলোপাথাড়ি চড় থাপ্পড় মারতে শুরু করল মেয়েটা।
পিটার হেমব্রম, বেদিয়াদের শেষ প্রতিনিধি কিন্তু তখন অবিচল! ক্রমেই তার মন্ত্র আরও উচ্চকিত হয়ে উঠতে লাগল।
এদিকে সে যে কী উস্তমকুস্তম লড়াই চলতে লাগল আমাদের মধ্যে সে বলে আর তোদের বোর করব না। অবশ্য লড়াই বলা ভুল। একতরফা ভাবে মার খেয়ে গেলাম। আঁচড়ে কামড়ে, লাথি চড় কিল ঘুষি মেরে আমাকে যেন খুনই করে ফেলবে মেয়েটা।
এত কিছুর মধ্যে শুধু এইটা একবার খেয়াল করলাম যে ওর শ্বদন্তদুটো হঠাৎ করেই একটু বড় দেখাচ্ছে যেন!
এদিকে পিটার সেই সাঁওতালি ভাষায়, অদ্ভুত সুরেলা গলায় মন্ত্র আউড়েই যাচ্ছে। থেকে থেকে উঁচু হচ্ছে তার গলার স্বর। নিজের আসন থেকে একটুও নড়েনি সে, বিচলিত হয়ে উঠে দাঁড়ায়নি একবারও।
এরই মধ্যে একবার নেতিয়ে পড়ল মহুয়া। অনেক কষ্টে সেই শীর্ণ শরীরটাকে বিছানায় শুইয়ে দিয়ে গভীর শ্বাস ছাড়লাম আমি। তারপর দেওয়াল ঘড়ির দিকে চোখ গেল।
রাত তিনটে।
আর ঘণ্টা দেড়েকের ব্যাপার। যদি কোনওক্রমে কাটিয়ে দিতে পারি…
এবার চোখ গেল পিটারের দিকে। অর্ধেক খাওয়ানো ওষুধের গ্লাসটা টেনে নিল সে। আর মন্ত্র বলতে বলতে মুরগির কাটা মাথাটা তুলে চিপে চিপে ঠিক একফোঁটা রক্ত ফেলল সেই মিশ্রণে। এবার ঘরের কোনায় একটা হামানদিস্তা টেনে নিল, আর সেই কালকেউটের বিষদাঁতটা তার মধ্যে ফেলে দিয়ে আরও কিছু মন্ত্র উচ্চারণ করতে করতে গুঁড়ো করতে লাগল সেই দাঁতটাকে। মিনিটখানেক পর সেই গুঁড়োগুলো গ্লাসের মধ্যে ফেলে গ্লাসটা আমার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে ইশারায় বলল, খাইয়ে দাও।
কাঁপা-কাঁপা হাতে গ্লাসটা হাতে নিলাম, আর আগের মতোই দাঁতের পাটির মধ্যে চামচ ঢুকিয়ে কালকেউটের বিষদাঁত শুদ্ধু সেই ওষুধটা ঢেলে দিলাম মহুয়ার গলায়। ওঁক করে একটা আওয়াজ তুলে সেটা খেয়েও নিল মেয়েটা।
কেটে গেল আরও মিনিট কুড়ি।
রাত সাড়ে তিনটে। আর আধ ঘণ্টা থেকে পঁয়তাল্লিশ মিনিট।
আমি তাকিয়ে ছিলাম পিটারের দিকে। দেখি শিরদাঁড়া টানটান করে উঠে বসেছে ছেলেটা। তীক্ষ্ন চোখে তাকিয়ে আছে মহুয়ার বিধ্বস্ত শরীরের দিকে। আমার দিকে সামান্য ঘাড় ঘুরিয়ে একবার তাকাল সে, আর দেওয়াল ঘড়ির দিকে তাকিয়ে কী যেন একটা মনে মনে ক্যালকুলেট করে নিল। তারপর ফিসফিস করে বলল, এইবার, শেষ কামড়।
অথচ আমি কিছুই দেখতে পেলাম না। শুধু খেয়াল করলাম যে মৌয়ের মুখ থেকে নীলচে সবুজ গ্যাঁজলা উঠতে শুরু করেছে, ওই শীতের রাতেও কপাল থেকে দরদরিয়ে নামছে ঘামের স্রোত। মুখটা অদ্ভুতভাবে লম্বাটে হয়ে গেছে, ক্রমশ কালো হয়ে উঠছে চামড়ার রং। তার ওপর শেষসময় উপস্থিত হলে মানুষ যেমন লম্বা লম্বা শ্বাস নেয়, সেইরকম শ্বাস নিচ্ছে মেয়েটা।