এরই মধ্যে অবাক হলাম পিটারের আচার আচরণ দেখে। কলকাতার অন্যতম বিখ্যাত মেডিক্যাল কলেজ থেকে পাশ করা একজন ডাক্তার যে শিলনোড়াতে বিভিন্ন অজানা লতাপাতা আর ছোট ছোট ফল পিষে, তাদের রস বার করে বিভিন্ন ছোট ছোট কাচের বাটিতে রাখতে পারে, সেটা দেখাটাও একটা অভিজ্ঞতা বটে।
আমি এসে দরজায় দাঁড়াতে আমার দিকে চোখ তুলে চাইল পিটার। আমি জিগ্যেস করলাম, এগুলো কী, পিটার?
সেসব পরে বলছি। আগে বলো ভৈরবীমাঈ কী বললেন?
এটা বলার পরই ওর চোখ গেল আমার হাতে ঝুলে থাকা সেই মহাশঙ্খমালাটির দিকে। সরু চোখে একবার তাকাল তার দিকে, আর মুহূর্তখানেক পরেই বিস্ফারিত হয়ে উঠল ওর চোখ দুটো। হাতের কাজ ছেড়ে দ্রুতপদে উঠে এল সে, বিস্মিত গলায় জিগ্যেস করল, ‘এটা কোথায় পেলে দীপান্বিতা?
ওকে বলতেই হল আমাদের পুরো অভিযানের ঘটনাটা। পুরোটা মন দিয়ে শুনল পিটার। খেয়াল করলাম যে, ভৈরবীমায়ের শিরদাঁড়া বেয়ে আলোর ফুল ওঠার কাহিনিটা বর্ণনা করার সময় তন্ময় হয়ে একাগ্র দৃষ্টিতে আমার দিকে চেয়ে আছে ও, দু’চোখে অপার বিস্ময় আর শ্রদ্ধার ভাব।
এটা নিয়ে কী করতে হবে সে কথা ভৈরবী মা কিছু বলে দেননি। আমি কী করব ঠিক করতে না পেরে শেষে মালাটা গিয়ে অতিকষ্টে মহুয়ার গলায় পরিয়ে দিলাম।
আর খেয়াল করলাম যে ওর গা’টা ঠান্ডা। ভীষণ ঠান্ডা। প্রায় মরামানুষের মতো।
পিটার ততক্ষণে ওর কাজ শেষ করে এনেছিল প্রায়, একটা বড় বাটিতে বিভিন্ন অনুপাতে মেশাচ্ছিল ওষুধ গুলো। মহুয়াকে মালাটা পরিয়ে দেওয়ার পর আমার দিকে তাকাল একবার, খেয়াল করলাম অসম্ভব গম্ভীর হয়ে আছে মুখটা। আমাকে শুধু একবার জিগ্যেস করল, কালিয়া মাসান? তাই বললেন ভৈরবী মা? ঠিক শুনেছো তুমি?
জলভরা চোখে মাথা নাড়লাম একবার।
মাথা নামিয়ে ফের নিজের কাজ করতে করতে বিড়বিড় করতে থাকে সে, কালিয়া মাসান তা হলে। আমিও তাইই ভেবেছিলাম, তাই সেইমতই এগুলো আনতে দিই। শোনো এখন যেটা বানাচ্ছি, এটাকে বলে মাসানকাটার রস। জটামাংসী, মারহাটিটিগা গাছের ফুল, গুড়মারবুটির লতা, হিমচাঁপার পাপড়ি, কাকমাচির ফল, ডুলিচাঁপা ফুলের কেশর আর এইটা, বলে একটা ছোট লতার কাটা অংশ তুলে ধরে সে—বিষকাটালীর ফুলশুদ্ধু লতা, এই হচ্ছে এর প্রধান উপাদান। কপাল ভালো যে এগুলোর সব কটাই একচান্সে পেয়ে গেছি। তবে যেটা ভাবছিলাম একেবারেই পাব না, সেটা হচ্ছে এইটা, বলে মার্বেল গুলির মতো কালো কালো কয়েকটা কী যেন তুলে দেখাল,—কালধুতরোর বীজ। একমাত্র এই জঙ্গলেই পাওয়া যায়, গোখরো সাপের বিষের থেকে কম কিছু নয়। এ জিনিস খুঁজে পাওয়া অনেক ভাগ্যের কথা, বলে ফের কাজে মন দেয় পিটার।
ইয়ে, পিটার, তুমি কি জেনেশুনে এই কালধুতরোর বিষ মেশাচ্ছ ওষুধে?’ সন্দেহ যায় না আমার। ধুতরো গাছের বীজ যে তীব্র বিষ সেটা জানা ছিল আমার।
মৃদু হাসে সেই শক্তপোক্ত শরীরের সাঁওতাল ছেলে, যা বিষ তাই অমৃত, যা অমৃত তাই বিষ, বাবা বলতেন। সবই নির্ভর করে তুমি যদি জানো কখন কতটা কীভাবে ব্যবহার করা উচিত তার ওপরে, তাই না?
আর, আর…কথাটা মুখে এসেও আটকে যায়, ভৈরবী মা যে বললেন যে…যে…যে লোকটা এই বিষ খাইয়েছে তার রক্ত লাগবে এই বিষের প্রতিষেধক হিসেবে?
রক্ত? ভুরু কুঁচকে যায় পিটারের, যদিও এ ওষুধ বড় ডেঞ্জারাস ওষুধ, বাবা বারবার বলতে, সামান্যতম ভুলচুকে মহাসর্বনাশ হয়। তবে মহারক্তের কথা তো তিনি বলেননি কিছু! এই মাসানকাটার একটি ফোঁটাও মাটিতে অবধি ফেলতে নেই, রোগীকে পুরোটাই খাইয়ে দিতে হয়, এত তীব্র এই বিষ-ওষুধ। তিনি এসব শিখেছিলেন আমার ঠাকুর্দার কাছ থেকে। তিনি আবার তাঁর বাবার কাছ থেকে। এঁরা কেউই জীবনে এক আধবারের বেশি বানাননি মাসানকাটার ওষুধ। হ্যাঁ, এটা শুনেছি যে এনারা কখনও নিজের হাতে এই ওষুধ কোনও রুগিকে খাওয়াননি, অন্য কারও হাতে, বিশেষ কারও হাতে খাইয়েছেন। কিন্তু, কই কোথাও তো কারও রক্তের কথা বলা নেই।
ফের সবকিছু গুলিয়ে যায় আমার। তাহলে ভৈরবীমা কি ভুল বললেন? উনি যে স্পষ্ট করে বললেন, যে প্রয়োগ করেছে এই অব্যর্থতম মৃত্যুবাণ, তারই রক্ত এই বিষের একমাত্র প্রতিষেধক?
ইতিমধ্যে সবকিছু তৈরি করে ফেলেছিল পিটার। এরপর ও আমাকে ছাড়া সবাইকে বলল ঘর থেকে চলে যেতে। ঘর খালি হলে আমার দিকে ঘুরল, তারপর গম্ভীর স্বরে বলল, এবার এই ওষুধটা ওকে খাওয়াতে হবে দীপান্বিতা। ওটা তোমাকেই খাওয়াতে হবে, কারণ আমি তখন মন্ত্র পড়ব। আমার বাবাকেও দেখেছি অন্য কাউকে দিয়ে খাওয়াতে। তবে সেটার জন্যে সবাইকে চলে যেতে বলিনি।
তাহলে?
ওষুধ খাওয়ানোর পর নেক্সট দুই থেকে তিনঘণ্টা মেয়েটা অসম্ভব কষ্ট পাবে। সে কষ্ট চোখে দেখা যায় না। ওই জন্যে বাকিদের সরিয়ে দিলাম। ওই সময়টুকুর জন্যে ওকে সামলে রাখাটা খুব জরুরি। যদি সেই সময়টা পেরিয়ে যায় তো এযাত্রা বেঁচে গেলো। নইলে…এই বলে চুপ করে গেল সে।
ওষুধটা খাওয়াতে তেমন বেগ পেতে হল না। একটা চামচ ওর দাঁতের ফাঁকে ঢুকিয়ে দিয়ে আস্তে আস্তে ওষুধটা ঢেলে দিতে লাগলাম। আর তখনই খেয়াল করলাম যে ওর দাঁতগুলো কালো হয়ে আছে। মুখের নীলভাবটা আরও কালচে হয়ে উঠেছে। চোখদুটো বোজাই আছে, তাদের দুইপ্রান্তে শুকিয়ে যাওয়া চোখের জলের দাগ।