কী সেই বিষ, মা? জিগ্যেস করতে গিয়ে গলাটা আমার কেঁপে গেল।
ফিসফিস করে দুটো শব্দ উচ্চারণ করলেন ভৈরবীমা, আর আমার শিরদাঁড়া দিয়ে একটা ভয়ের হিমেল স্রোত যেন নেমে গেল।
কালিয়া মাসান!
এই শব্দ দুটো বারবার উচ্চারণ করেছে লোকটা, মিলিয়ে যাওয়ার আগের মুহূর্তে প্রত্যেকবার। তখন বুঝিনি, আজ ভৈরবীমায়ের কথা শুনে বুঝতে পারছি, কোন অভিশাপ বয়ে এনেছে এই শব্দ দুটো আমাদের জীবনে!
সেইরকমই ধীর চাপা গলায় বলতে লাগলেন তিনি—
অকালে অপঘাতে মৃত কোনও শব দাহ করার পর তার যে ছাই পড়ে থাকে, সেটাই হচ্ছে কালিয়া মাসানের মূল উপাদান। সেই ছাই যদি বিশেষ তান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় শোধিত করা যায়, তবে তা হয়ে দাঁড়ায় অব্যর্থতম মৃত্যুবাণ। যাকে মারতে হবে, কোনও উপায়ে তাকে একবার খাইয়ে দিতে হবে সেই ছাই। ব্যস, তারপর যতক্ষণ না স্বয়ং মৃত্যু এসে সেই হতভাগ্যটির প্রাণহরণ করে তাকে অশেষ কষ্টের হাত থেকে মুক্তি দিচ্ছেন, ততক্ষণ সেই মন্ত্রপূত ছাই তার পেটে বসে থাকে, আর বিষসঞ্চার করে তার সারা শরীরে। তাকে ঘুমোতে দেয় না, উঠতে দেয় না, বসতে দেয় না। তার স্বপ্নে উঠে আসে নরকের বীভৎস, ভয়ঙ্করতম, পূতিগন্ধময়, নির্মম দৃশ্যাবলী। অপঘাতে মৃত যে মানুষটির শবদাহের ছাই খাওয়ানো হয়েছে, তার প্রেতাত্মা থেকে থেকে ভর করে অভিশপ্ত মানুষটির শরীরে।’
এর থেকে পরিত্রাণের কোনও উপায় নেই মা?
আছে। মৃত্যু।
আমার মনে হল যেন হৃৎপিণ্ডটা আমার গলার কাছে উঠে এসেছে। মুখ দিয়ে কথা সরছিল না আমার।
আমার বন্ধুকে কলকাতা নিয়ে যেতে চাই মা। কাল সকাল অবধি…
আমাকে থামিয়ে দিয়ে হাত তুললেন তিনি, ক্লান্ত গম্ভীর গলায় বললেন, না। পারবি না। আজকের রাতটা কাটবে না।
নিজের বুকের ধ্বক ধ্বক শব্দটা নিজেই স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছি।
এর থেকে মুক্তির কোনও উপায়?—আমার গলায় আর কোনও সাড় ছিল না।
বিষণ্ণভাবে মাথা নাড়লেন তিনি। তারপর কিছু ভেবে উঠে গেলেন গুহার একটু ভেতর দিকে, আর হাতে করে মালার মতো কী একটা নিয়ে এলেন। বিড়বিড় করে সেটা আমার হাতে দিয়ে বললেন, এটা নিয়ে যা, তোর বন্ধুর গলায় পরিয়ে দিস। দেখি মহামায়া এই বেটির কথা শোনেন কি না।
মালাটা হাতে নিয়ে সভয়ে দেখি ছোট ছোট হাড়ের তৈরি মালাটা। কাঁপা-কাঁপা গলায় জিগ্যেস করলাম, এটা কীসের মালা মা?
এ হল মহাশঙখের মালা। চণ্ডালের অস্থি দিয়ে তৈরি।
ভয়ে হাতটা কেঁপে গেল আমার, তারপর মন শক্ত করে হাতে নিলাম ওটাকে, ‘এতে সব ঠিক হয়ে যাবে তো মাঈজি? আমার বন্ধু ভালো হয়ে যাবে তো? আকুলস্বরে প্রশ্ন করলাম।
বলতে পারব না রে বেটি। যেটা হাতে পেলে কিছু করতে পারতাম সেটা পাওয়ার কোনও উপায়ই নেই যে। দুঃখিত স্বরে বলেন তিনি।
কী সেটা, মাঈজি? আগ্রহে এগিয়ে বসলাম।
চুপ করে থাকেন সেই ভূয়োদর্শী তন্ত্রশাস্ত্রজ্ঞ মহিলা। তারপর আমার চোখে চোখ রেখে বলেন, সেটা হচ্ছে, যে এই জাদুটোনা করেছে, তার রক্ত। তার রক্ত ছাড়া এই মৃত্যুবাণের আর কোনও প্রতিষেধক নেই।
গলার স্বরে কোথায় যেন একটা তিক্ত কৌতুকের রেশ শোনা যায়, আর তারই সঙ্গে এই রক্ত পাওয়া শুধু যে কঠিন তা নয়, অবাস্তবও বটে। কোনও মরমানুষের পক্ষে তার নাগাল পাওয়া বা তার রক্ত পাওয়া।
এইবার বিস্মিত হওয়ার পালা আমার। মরমানুষের পক্ষে নাগাল পাওয়া শক্ত কেন? আর নাগাল পেলে তার রক্ত পাওয়া যাবে না কেন?
ভৈরবী মা আমার মুখের দিকে তাকিয়ে ছিলেন। আমার মনের কথা পড়ে ফেলতে বেশি সময় লাগল না ওনার। আমার চোখে চোখ রেখে স্থির স্বরে বললেন, এখনও বুঝিসনি, কেন ওর শরীর থেকে রক্ত পাওয়া সম্ভব নয়? সত্যি বুঝিসনি?
না মাঈজি, আমি বুঝিনি। রক্ত কেন পাওয়া যাবে না লোকটার? মানে ধরাটা খুব কঠিন হতে পারে, কিন্তু একবার ধরতে পারলে রক্ত…
‘কারণ, একটু যদি বিচার করে দেখতিস মেয়ে, ফিসফিস করে বলেন তিনি, ‘তাহলে অনেক আগেই বুঝতে পারতিস যে ওর শরীরে রক্তমাংস বলে আর কিছু নেই।’ এই বলে থামেন তিনি। তারপর ওনার গলার স্বর আরও ঘন হয়ে আসে, আমার শিরশিরানি ভাবটা আরও বাড়িয়ে দিয়ে ফিসফিস করে বলেন তিনি, ‘ওর শরীরটা শুধু ছাই দিয়ে তৈরি, ও ছাইয়ের মানুষ।
ভৈরবীমা’কে প্রণাম করে, সেই মহাশঙ্খের মালা নিয়ে বেশ রাতে যখন পৌঁছলাম বাংলোয়, তখন দেখলাম যে মহুয়ার অবস্থা আরও শোচনীয়, দেখেই মনে হচ্ছে যে, ওর শরীরে আর প্রাণ বলে কিচ্ছু নেই। নির্জীব হয়ে শুয়ে আছে বিছানায়, মুখ দিয়ে অল্প অল্প গ্যাঁজলা উঠছে। দরজায় ঠেস দিয়ে বসে আছে দীপাঞ্জন, উস্কোখুস্কো চুল, কান্নাকাটি করে চোখমুখ ফুলিয়ে ফেলেছে ছেলেটা। তার পাশে শক্ত মুখে বসে আছে জোশুয়া। বন্ধুর এই বিপর্যয়ে সেও যে খুব বিচলিত, সেটা তার মুখ দেখেই বোঝা যাচ্ছে।
শুনলাম ফেরার সময় স্টেশন হয়েই ফিরেছে জোশুয়া। রেংতার মোটর সাইকেল নিয়ে দাদার নির্দেশমতো বিভিন্ন জায়গায় গেছিল সে। আমাদের ফেরত আসার ঘণ্টাখানেক আগেই ফিরেছে আর যে খবরটা সঙ্গে করে এনেছে সেটা যে খুব খারাপ তা বলা যাবে না।
খবরটা হচ্ছে যে লাইনের ওপর থেকে জল সরে গেছে বিকেল থেকেই, ট্রেন চলাচল এক্কেবারে স্বাভাবিক। একবার যদি মেয়েটাকে কলকাতা নিয়ে গিয়ে ফেলতে পারি…