আমিও তো সেই গল্প শুনবার লোভেই এক এক লাফে তিনটে করে সিঁড়ি টপকে দোতলায় এলুম। আর আসা মাত্রই আমাকে দেখে সবাই হইহই করে উঠল। দীপুপিসি চেঁচালেন সবচেয়ে বেশি। বাবাকে ডেকে বললেন, ‘ও অধীরদা, ছেলে তো ম্যান হয়ে গেল গো! ক্লাস এইট হয়ে গেলো, তার ওপর কচি করে গোঁফ অবধি গজিয়ে গেছে দেখছি। এবার আমার হাতে ছেড়ে দাও দেখি, আমার সঙ্গে একটু ঘুরে দুনিয়াটা দেখুক। কী বলিস রে লম্বকর্ণ?’ আমি একটু লাজুক হেসে আর জবাব দেওয়ার জন্য দাঁড়াইনি। ব্যাগ রেখে দৌড়ে গিয়ে স্নান করার জন্যে টয়লেটে ঢুকে পড়েছি।
স্নানটান সেরে, সবাই মিলে লুচি আর কষা মাংস দিয়ে লাঞ্চ সেরে যখন ড্রয়িংরুমে এলাম, তখন অত বড় ঘরটা পুরো লোকজনে গমগম করছে। লোক বলতে অবশ্য আমরা জনা পাঁচেক কুচোচিংড়ি আর বাবা। মা বলল যে এখুনি মোক্ষদা মাসিকে দিয়ে টেবিল পরিষ্কার করেই আসছে।
এদিকে আকাশ এসেছে কালো করে, জোরে হাওয়া দিতে শুরু করেছে। কালবৈশাখীর পূর্বাভাস আর কী! মা এসে বসতে না বসতেই চারপাশ অন্ধকার হয়ে এল। বড় বড় ফোঁটায় শুরু হল বৃষ্টি আর শোঁ-শোঁ শব্দে প্রবল ঝড়ে উথালপাতাল হয়ে উঠল চারিদিক। সে কী ঝড়ের গর্জন, বাবা রে! মা এসে ঝটপট দরজা জানলা বন্ধ করে বলল, ‘ও দীপুদি, একটা ভূতের গল্প বলো না, এই ওয়েদারে ভূতের গল্প দারুণ জমবে কিন্তু।’
কথাটা শুনে ভুরুটুরু কুঁচকে নাক উঁচু করে কী যেন ভাবলেন দীপুপিসি। তারপর গম্ভীরস্বরে বললেন, ‘দ্যাখ মণি, তুই তো জানিস, আমি ঘোর যুক্তিবাদী মানুষ। ভূতপ্রেত দত্যিদানো ডাইনি পিশাচ তাবিজ কবজ এসবে কোনওদিনই বিশ্বাস করিনি, আজও করি না। কিন্তু আজ থেকে বছর বিশ-বাইশ আগে সেবার পুরুলিয়াতে একটা ফিল্ডওয়ার্কে গিয়ে যা ভয়ানক অভিজ্ঞতা হয়েছিল, সেটাকে আর অন্য কিছু বলে উড়িয়ে দিতে পারিনি। গল্পটার পুরোটা আমিও প্রথমে বুঝিনি। পরে অবশ্য পিটার, মানে পিটার হেমব্রমের পারিবারিক কাহিনি শুনে সবটা জোড়াতালি দিয়ে পুরো কাঠামোটা দাঁড় করাবার চেষ্টা করি। গল্পটা বলি শোন।’
আমরা সবাই গা ঘেঁষে বসলাম, দীপুপিসির ফেমাস গল্প শুরু হতে চলেছে। দিল থামকে বৈঠিয়ে ভাইলোগ…
‘সেদিনও ছিল এমনই একটা ঝড়বৃষ্টির দিন, বুঝলি।’
কোলবালিশটাকে কোলে জাপটে ধরে তার ওপর ভর দিয়ে বলতে শুরু করলেন দীপুপিসি, ‘আমি তখনও কলেজে, ফাইনাল ইয়ার চলছে। তোরা তো জানিসই, আমার বাবার বদলির চাকরি ছিল। তখন বাবার পোস্টিং হাবড়াতে। হাবড়া বলতে আবার হাওড়া বুঝিসনি বাপু। বারাসাত পেরিয়ে তবে হাবড়া-অশোকনগর। এখন তো জায়গাটা পুরোদস্তুর শহর হয়ে উঠেছে, আমাদের ছোটবেলায় হাবড়া-অশোকনগর গাঁ গেরাম ছিল বললেই চলে। তারই মধ্যে আমাদের কলোনিটাই ছিল যা একটু ভদ্রস্থগোছের। দূরে দূরে ছড়ানো একতলা বাড়ি, প্রায় সব বাড়ির সামনে ফুলের কেয়ারি করা বাগান। আর বাড়ির পেছনে অনেকটা জায়গা জুড়ে বেড়া দিয়ে বাঁধা। তখন সবে টিভি এসেছে আমাদের ওদিকে। তাতে একটা মাত্র চ্যানেল, তাও বহু কষ্টে সন্ধেবেলায় কয়েক ঘণ্টার জন্যে দেখার পারমিশন পেতুম। এই তোদের মতো নাকি, এখন তো দেখি কোটিখানেক চ্যানেল, যখনই টিভি খুলি, দেখি ভূতের নেত্য চলছে, হুঁঃ।
সে যাই হোক। পার্ট ওয়ান সবে শেষ হয়েছে, পুজো শেষ হলেও সেবার বর্ষা চলেছিল আরও মাসখানেক। মাস দেড়েক বাদে আমাদের একটা ফিল্ড ওয়ার্ক আছে পুরুলিয়াতে, তারই প্রিপারেশন নিচ্ছি তখন। সে বছর তখনও ভালো করে শীত পড়েনি, তবে পড়বে পড়বে করছিলো, বুঝলি। তবে পুরুলিয়া ফিল্ড ওয়ার্কের ডেট নভেম্বরের সেকেন্ড উইক নাগাদ। আবহাওয়া আপিস বলছিল যে ততদিনে জাঁকিয়ে শীত পড়ে যাবে। সেই আশাতেই ছিলুম।
দিনটা ছিল খুব সম্ভবত শনিবার, তার ওপর অমাবস্যা। আমি আর আমার বান্ধবী মহুয়া গেছিলাম কলেজ স্ট্রিট, কিছু বই কিনতে। অধীরদা, তোমার মহুয়াকে মনে আছে কি?’ শেষের প্রশ্নটা অবশ্য বাবার উদ্দেশ্যে।
বাবা এতক্ষণ চুপচাপ বসে গল্প শুনছিল। নড়েচড়ে উঠে বসল এবারে, ‘তোদের জিওলজির মহুয়া? খুব ভালো গান গাইতো যে মেয়েটা? যার বাবা ডাক্তার ছিলেন?’
‘হাঁ হ্যাঁ সেই মহুয়াই,’ সায় দিলেন দীপুপিসি, ‘ওর বাবা বিশ্বনাথ চৌধুরী আমাদের ওদিকে খুব পপুলার ডাক্তার ছিলেন। গ্রামের লোকে বলত বিশ্বনাথ ডাক্তার সাক্ষাৎ ধন্বন্তরি। মুখ দেখলে অর্ধেক অসুখ এমনিতেই সেরে যায়, ওষুধের খরচা বাঁচে! বিশ্বনাথকাকুকে অনেকবার দেখেছি কম্পাউন্ডার কাকুকে ডেকে গরিবগুর্বো পেশেন্টদের ফ্রি’তে ওষুধ দেওয়ার জন্যে বলে দিতে। এছাড়াও কতবার যে কতশত মরণাপন্ন রোগীকে বিশ্বনাথকাকু বাঁচিয়ে তুলেছিলেন তার ইয়ত্তা নেই। মহুয়াদের বাড়িতে আমাদের অবারিত দ্বার ছিল, প্রায়ই যেতাম। কতবার দেখেছি সারা রাত ধরে কোনও রোগীর দেখাশোনা করে কাকু ক্লান্ত শ্রান্ত দেহে বাড়ি ফিরছেন। সারা হাবড়া-অশোকনগর জানত যে বিশ্বনাথ ডাক্তারের ভিজিট ছিল দু-টাকা, এবং সেটা না দিলেও ডাক্তারবাবু কিচ্ছুটি বলেন না! আমরা তো টাকার বদলে লাউ, কুমড়ো, এক বস্তা আলু, এসব নিয়েও গ্রামের লোকেদের উপস্থিত হতে দেখেছি। একবার তো এক মুসলিম ভদ্রলোক জ্যান্ত মুরগি নিয়ে হাজির, সে নিয়ে আবার আমাদের বন্ধুদের মধ্যে সে কি হাসাহাসি..’