ভৈরবী মা বোধহয় আমার মুখের দিকে তাকিয়ে বুঝে নিলেন আমার মনের অবস্থাটা। ইঙ্গিতে বসতে বললেন আমাদের তিনজনকে। তারপর আমাকে বললেন, ‘ঠিক কী ঘটনা ঘটেছে সেটা একটু বিস্তারিত বলবি? কিচ্ছু বাদ দিবি না কিন্তু।’
আমি বলতে শুরু করলাম সেই কলেজ স্ট্রিটের ঘটনাটা থেকে। তারপর আমাদের পুরুলিয়া আসা থেকে শুরু করে গতকালের ঘুগনি খাওয়া থেকে মহুয়ার অসুস্থ হয়ে পড়া অবধি বলতে সময় লাগল প্রায় দশ মিনিট।
তারপর চারজনেই কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে থাকলাম। নিশ্চুপ নিস্তব্ধ সেই কয়েকটা মুহূর্ত আমার কাছে মনে হচ্ছিল যেন অনন্ত সময়।
বুধন! সেই নৈঃশব্দ খান খান করে গম্ভীর গলায় বলে উঠলেন ভৈরবীমা,—প্রদীপটা নিভিয়ে দাও, আমি ধ্যানে বসব। আজ শুক্লা নবমী, দেখি জগন্মাতার কৃপা হয় কী না।
বুধনদা চুপচাপ উঠে প্রদীপটা হাতের বাতাস দিয়ে নিভিয়ে দিয়ে আমার পাশে এসে বসল। আর এতক্ষণ যে অন্ধকার অনেক চেষ্টা করেও গুহাতে ঢুকতে পারছিল না, সে যেন খোঁচা খাওয়া বাঘের মতো ঝাঁপিয়ে পড়ল আমাদের ওপর।
আশেপাশে কিছু দেখতে পাচ্ছি না, এমন ঘন অন্ধকার। বাইরে ঝিঁঝিপোকার আওয়াজটা যেন বহুগুণ বেড়ে উঠল। তারই মধ্যে জঙ্গলের ডালপাতা ঝরার শব্দ শুনতে পাচ্ছি, ভেজা মাটি থেকে উঠে আসছে জংলি সোঁদা গন্ধ। আমরা চুপচাপ বসে আছি, এমন সময় শুনলাম ভৈরব মা বড় করে একটা শ্বাস নিলেন, আর অসম্ভব একটা গম্ভীর গলায় বলে উঠলেন, ওওওমম।
আর তারপরেই সামনের দৃশ্যটা দেখে আমার নিঃশ্বাস প্রায় বন্ধ হয়ে এল।
কী দেখলে পিসি?’ আমার গলা থেকে যে অমন চিঁ-চিঁ আওয়াজ বেরোতে পারে, সেটা আমি নিজেও জানতাম না।
পিসি আমাদের দিকে বড়বড় চোখ করে তাকালেন, তারপর বললেন, কী দেখলাম জানিস? দেখলাম যে যেখানে ভৈরবী মা বসেছিলেন, সেখানে মায়ের পেটের দিকে, আরও সঠিকভাবে বলতে গেলে নাভির জায়গায়টায় যেন একটা ধীর আলোর পদ্ম ফুটে উঠল!
ব্যাপারটা বলতে যতটা স্বাভাবিক লাগছে, দেখলে অতটা স্বাভাবিক লাগার কথা নয়, বুঝতেই পারছিস। পুরুলিয়ার কোন জঙ্গলের মধ্যে এক আদিম আরণ্যক গুহা, তার মধ্যে ধ্যানরতা তন্ত্রসিদ্ধা মায়ের শরীরের ভেতরে আলো জ্বলে উঠছে, এসব বাইরের লোক শুনলে গাঁজাখুরি গল্প ভাববে। অথচ তখনও কিছুই ঘটেনি, আমার অবাক হওয়ার তো সবে শুরু!
এরপর আলোটা আস্তে আস্তে ওপরে উঠতে লাগল।
ব্যাপারটা এতই অস্বাভাবিক যে বলে বোঝাতে পারব না। মানুষের শরীরের ভেতরে আলো, সেটা আবার নড়েচড়ে, এসব দেখে আমার স্বাভাবিক বোধবুদ্ধি সব গুবলেট হয়ে গেছিল। অথচ কিছু অস্বীকার করার নেই, যা ঘটছে সেটা চোখের সামনে স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি যে! তবে যেটা দেখে সত্যি আমার মাথা খারাপ হওয়ার জোগাড় হল, সেটা হচ্ছে আলোর পদ্মটা যে পথ ধরে ওপরে উঠছে সেই পথটা। স্পষ্ট বুঝতে পারছি যে পথটা আমার খুব চেনা, কিন্তু নিজেকে কিছুতেই সেটা বিশ্বাস করাতে পারছি না।
ওটা পথ নয়, ওটা মানুষের শরীরের একটা অংশ।
ওটাকে বলে মেরুদণ্ড, শিরদাঁড়া!
ওই আলোর ফুল ভৈরবী মায়ের শিরদাঁড়া বেয়ে বেয়ে ওপরে উঠছে। ঠিক সাপের মতো!
আমরা নিস্তব্ধ নির্বাক হয়ে বসে আছি। পেছন থেকে মংলাদা’বা বুধনদা, কোনও একজনের দাঁতে দাঁত লেগে যাওয়ার খটাখট শব্দ কানে আসছে। আমার চোখের পলক পড়ছে না, কোনওদিন যে এরকম দৃশ্য দেখতে পাবো সে কথা আমার কল্পনার অতীত ছিল।
এইবার লক্ষ্য করলাম শুধু যে ওটা উঠতে লাগল তা নয়, ধীরে ধীরে আরও ফুটতে লাগল। যখন সেই আলোর পদ্ম মায়ের গলার কাছাকাছি, তখন এক অলৌকিক স্নিগ্ধ দ্যুতি মায়ের সারা শরীর জুড়ে খেলা করছে।
সেই আলোর পিণ্ড যখন কণ্ঠার কাছাকাছি, তখন সেই আলোয় মায়ের শরীর যেন ঝলমল করছে। তার সঙ্গে সঙ্গে দেখলাম ভৈরবীমায়ের মাথার পেছনে ধীরে ধীরে ফুটে উঠেছে একটি স্বচ্ছ জ্যোতির্বলয়। স্নিগ্ধ জ্যোৎস্নাচন্দনের আলোয় ভেসে যাচ্ছে ছোট্ট গুহাটি। সেই আলোয় দেখতে পাচ্ছি যে ভৈরবীমায়ের চোখ বন্ধ, বজ্রাসনে বসে আছেন তিনি। তাঁর সারা শরীর ঘিরে খেলা করছে এক আশ্চর্য মায়াময় আলোর স্রোত। তাঁর মুখে জেগে আছে গম্ভীর, প্রশান্তচিত্ত ভাব।
গলার কাছ অবধি সেই আলোকপদ্ম পৌঁছতেই গভীরভাবে নিঃশ্বাস ছাড়লেন ভৈরবীমা। আর সেই অদ্ভুত আলোর খেলা দপ করে নিভে গেল।
মংলাদা বা বুধনদা, কেউই প্রদীপ জ্বালানোর অবস্থায় ছিল না। বুধনদা’র কোঁচড় থেকে দেশলাই নিয়ে সে কাজটা আমাকেই করতে হল।
প্রদীপ জ্বলে উঠলে দেখলাম মায়ের মুখটা গম্ভীর আর ভ্রুকুটিকুটিল হয়ে আছে। মাথা নীচু করে খানিকক্ষণ কী যেন ভাবলেন তিনি, তারপর মেরুদণ্ড টানটান করে সোজা হয়ে বসলেন, আর আমার দিকে চেয়ে বলতে শুরু করলেন।
শোন রে মেয়ে। তোর বন্ধুর ওপরে কেউ তুক করেছে, আর করেছে খুব বড় কোনও গুণিন বা গুণিনেরা। এমনকী প্রাচীন ডাকিনীবিদ্যায় পারদর্শী কেউ হলেও অবাক হব না, এতই ভয়ঙ্কর সেই কালোজাদু। মারণ উচাটন বুঝিস?
ও দুটো বিষয়ে জানা ছিল কিছু কিছু। নিজের অজানতেই ঘাড় নাড়লাম।
তবে শুনে রাখ, যে বিষ এই মুহূর্তে তোর বন্ধুর শরীরে কালকেউটের মতো বাসা বেঁধে আছে, তার থেকে জটিলতম, বীভৎসতম, অব্যর্থতম মৃত্যুবাণ আর নেই, ভৈরবীমায়ের গম্ভীর গলায় যেন গমগম করতে লাগল গুহাটা।—অনেক শোকতাপ পেয়ে তবেই এই তুক করার রাস্তা বেছেছে কেউ। মনের মধ্যে জ্বলতে থাকা দহনজ্বালা যখন সহ্যের অতীত হয়ে যায়, তখন তার থেকে মানুষের চিন্তায় ভয়ঙ্কর বিষ উৎপন্ন হয়। তার পাপপুণ্য, ভালোমন্দের জ্ঞান লুপ্ত হয়ে যায়। এত দুঃখকষ্ট, জ্বালা পেরিয়ে এই মহাবিষের উৎপত্তি, তাই এর কোনও প্রতিষেধক নেই বললেই চলে।