‘ওদের কথা শুনে বুঝলাম যে, গতকাল রাতে বারান্দায় সেই ভয়াবহ আবির্ভাবটির ব্যাপারে রেংতা আমাদের মংলাদা’কে যথেষ্ট ভালোভাবেই অবহিত করেছে। তার সঙ্গে অতর্কিতভাবে মহুয়ার এতটা শরীর খারাপ হওয়াটা ওরা ঠিক স্বাভাবিকভাবে মেনে নিতে পারছে না। ওদের মতে এসব ঠিক স্বাভাবিক ঘটনা নয়। এর পেছনে নাকি তাঁরা আছেন।
তাঁরা কারা? আমি জিগ্যেস করেছিলাম।
দেও’রা। বোঙ্গারা। ওঁরা রাগলেই এইরকম সৃষ্টিছাড়া কাণ্ড ঘটে। তখন ভালোমানুষদেরও অমন কষ্ট পেতে হয়। দোহাই দিদি, আমাদের কথা শুনে তুমি একটিবার ভৈরবী মায়ের থানে চল। মৌদি’র এত কষ্ট আর দেখা যায় না যে। একটি বার আমাদের কথা শোনো দিদি, যদি ভালো হয়? ক্ষতি তো কিছু নেই।’
কী জানিস, ওইরকম একটা পরিস্থিতিতে, অযোধ্যা পাহাড়ের জঙ্গলঘেঁষা সেই পুরোনো ব্রিটিশ আমলের বাংলোর বারান্দায় দাঁড়িয়ে আমার মাথাটা কেমন গুলিয়ে গেলো। সে তোরা আমাকে ভীতু, বা কুসংস্কারগ্রস্ত বা অন্যকিছু বলতে পারিস, কিন্তু সেইখানে দিশেহারা অবস্থায়, ওইরকম পরিস্থিতিতে আমার মাথা আর কাজ করছিল না। আমার কেমন যেন মনে হচ্ছিল এই লোকদুটো যা বলছে তা সত্যি হলেও হতে পারে!
ক্ষীণ কণ্ঠে বললাম, কার কথা যেন বললে, কোন মা না কী যেন, ওখানে গেলে কোনও সুরাহা হতে পারে বলছ?
দুজনেই যেন একটু শিউরে উঠল কথাটা শুনে, মংলাদা তো হাতদুটো নমস্কারের ভঙ্গিতে মাথায় ঠেকিয়ে নিল একবার রেংতা বলল, ওমন বোলো না দিদি, ভৈরবী মা সাক্ষাৎ দেবী গো। ভূতপ্রেত দত্যিদানো সব্বাই মায়ের আঁচলে বাঁধা থাকে যে। নইলে গেল মাসে বলরাম মাহতোর প্রায় মরে যাওয়া মেয়েকে সারিয়ে তোলা কী যার তার কম্মো গো দিদি?
দুজনে আরও অনেক আগড়ম বাগড়ম বকে যাচ্ছিল। অতি কষ্টে সেসব থামিয়ে দুজনের ভক্তিপ্রণত প্রলাপ শুনে যেটা উদ্ধার করলাম সেটা হচ্ছে যে এই ভৈরবী মা তান্ত্রিক বা তন্ত্রবিদ গোছের কোনও সাধিকা কেউ। বেশিদিন হল এখানে আসেননি, কিন্তু এর মধ্যেই খুবই জনপ্রিয় হয়ে পড়েছেন স্থানীয়দের মধ্যে। মোটমাট বোঝা গেল এখানকার লোকেদের দৃঢ় বিশ্বাস মা বিশেষ দৈবী শক্তির অধিকারী। তাঁর কাছে গিয়ে কেঁদে পড়লে কিছু না একটা ব্যবস্থা হয়ে যাবেই।
খানিকক্ষণ ভেবে জিগ্যেস করলাম, ‘কোথায় যেতে হবে? কত দূরে?
ভাবছিলাম যাওয়াটা ঠিক হবে কি না। আরও ভালো করে বলতে গেলে, গিয়ে কোনও লাভ আছে কি না। অন্যমনস্ক হয়ে একবার আমাদের ঘরের দরজায় গিয়ে দাঁড়ালাম।
আমার চোখ পড়ল বিছানার সঙ্গে প্রায় মিশে যাওয়া মহুয়ার মুখের দিকে। তারপর আর ভাবিনি। রেংতাকে আর দীপাঞ্জনকে মহুয়ার কাছে রেখে আমি বুধনদা আর মংলাদা’র সঙ্গে বেরিয়ে পড়লাম।
‘সেই মায়ের থানে গিয়ে যখন পৌঁছলাম, তখন ঘোর সন্ধে। কী করে যে সেই ঘুরঘুট্টি অন্ধকারের মধ্যে বনবাদাড় পেরিয়ে ভৈরবী মায়ের কাছে পৌঁছলাম সে কথা জিগ্যেস করিসনি, সে আমার মনেও নেই। ঘোর বিপদের মুখে আমরা এমন সব কাজ করে ফেলতে পারি, যেটা হয়তো স্বাভাবিক অবস্থায় করার কথা চিন্তাই করতে পারতাম না। বুধনদা আর মংলাদা না থাকলে যে ওই জায়গায় যেতে পারতাম না সে কথা বলাই বাহুল্য। ওরা জঙ্গলের লোক, হাতের তালুর মতো চেনে জায়গাটাকে।
শেষমেশ যেখানে এসে উপস্থিত হলাম সেটা অযোধ্যা পাহাড়ের, যাকে বলে পাদদেশ, সেইরকম একটা জায়গায়। একটা ছোট শুঁড়িপথ হাঁচোরপ্যাঁচোর করে উঠে এসে দেখি একটা বেশ বড় চাতাল, আর তার সামনে একটা ছোট গুহা মতো। সঙ্গী দুজনের প্রণামের ঘটা দেখে বোঝা গেল ভৈরবীমা এখানেই থাকেন।
দুজনে খানিকক্ষণ ইতস্ততভাবে মৃদুস্বরে ডাকাডাকি শুরু করার মিনিটখানেকের মাথায় গুহার মুখে এসে দাঁড়ালেন তিনি।
সঙ্গে সঙ্গে বুধনদা আর মংলাদা সাষ্টাঙ্গে প্রণিপাত করে মা’কে বোঝাতে লাগল কেন সন্ধের পর মায়ের কাছে আসা বারণ থাকা সত্ত্বেও আজ ওরা আমাকে নিয়ে আসতে বাধ্য হয়েছে। একটা নির্দোষ মানুষের প্রাণ বাঁচানোর জন্যেই যে এটা করা সে কথাও বারবার বলতে লাগল দুজনে।
আমি ভৈরবীমায়ের দিকে চেয়েছিলাম। দেখেই বোঝা যাচ্ছিল যে, ইনি এদিককার লোক নন। উচ্চতায় খুব বেশি হলে পাঁচ ফুটের একটু ওপরে। দোহারা চেহারা, পরনে গেরুয়া শাড়ি। মাথায় একঢাল চুল জটা বেঁধে আছে। তবে আমাকে সবচেয়ে বেশি যেটা আকর্ষণ করল সেটা হচ্ছে ওনার মুখশ্রী। একটা অদ্ভুত প্রশান্তি ছেয়ে আছে সারা মুখে। সেখানে কোনও কষ্ট, কোনও দুঃখ, কোনও চিন্তা বা উদ্বেগের চিহ্নই নেই। দেখলেই বুকের ভেতরটা কেমন ঠান্ডা হয়ে যায়। বুধনদা আর মংলাদা’র কথা শুনেটুনে হাতের ইঙ্গিতে ভৈরবীমা আমাদের ভেতরে আসতে বললেন। আমরাও ওনার পেছন পেছন একটু মাথা নীচু করে গুহায় ঢুকে পড়লাম।
গুহার ভেতরে গিয়ে দেখি তেমন সরঞ্জাম কিছুই নেই। একটা বড় মাটির প্রদীপ জ্বলছে একপাশে, আর একপাশে একটা মাটির কলসী, বোধহয় জল খাওয়ার জন্য। আমার চোখ পড়ল মেঝেতে পেতে রাখা জীর্ণ, কিন্তু মস্তবড় বাঘছালটার ওপর। আমি ওদিকে তাকিয়ে আছি দেখে অল্প হাসলেন উনি, তারপর দেহাতী হিন্দিতে বললেন, ওটা আমার গুরুজির, অমৃতলোকে যাত্রা করার সময় আমাকে দিয়ে যান। উনি পেয়েছিলেন ওঁর গুরুজির কাছে। এই বলে মাথায় হাত ঠেকালেন। লক্ষ্য করলাম যে আশ্চর্য সুরেলা কণ্ঠ ওঁর।