পিটার ওর সঙ্গে থাকা কিট থেকে যন্ত্রপাতি বার করে অনেক কষ্টে কিছু পরীক্ষাটরিক্ষা করল। ওর কপালের গভীর ভাঁজ দেখেই বুঝেছিলাম যে কেস বহুত গড়বড়। আমাকে বাইরে ডেকে পিটার বলল যে, ‘খুব সিভিয়ার ইনফেকশন। শরীরের অবস্থা ভালো নয়। হার্টবিট একশোর ওপরে। ব্লাড প্রেশার সিক্সটি বাই ফর্টি। যে কোনও মুহূর্তে কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট হতে পারে। কিন্তু’…এই বলে ভ্রু কুঁচকে কী যেন একটা ভাবতে লাগল পিটার।
কিন্তু কী? জিগ্যেস করতেও আমার বুক কাঁপছিল।
তার সঙ্গে আরও কিছু একটা আছে যেটা ধরতে পারছি না। আরও বেশ কিছু টেস্ট দরকার, সেসব কলকাতার ফেসিলিটি ছাড়া করানো অসম্ভব। আমার সিনিয়রকে একবার আনতে পারলে হত…এই বলে ভ্রু কুঁচকে দাঁড়িয়ে থাকে ছেলেটি। তারপর বলে, জোশুয়াকে একটু কাছেই এক জায়গায় পাঠাচ্ছি, কয়েকটা জিনিস আনার জন্যে। আমার যেন কেমন অন্য একটা সন্দেহ হচ্ছে।
কী সন্দেহ পিটারদা? জিগ্যেস করে দীপাঞ্জন।
পিটার প্রথমে কিছু বলে না। অযোধ্যা পাহাড়ের দিকে গম্ভীর মুখে তাকিয়ে থাকে সে। তারপর বলে, ‘জানি না কথাটা আপনাদের বলা ঠিক হচ্ছে কি না। আপনারা শহুরে লোক, আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত। আমিও যদিও তাই, কলকাতা শহরে ডাক্তারি পড়েছি, নিজেকে অশিক্ষিত বলি কী করে?
কিন্তু আমার মতে এখন এখানে এমন কিছু একটা ঘটছে, যেটাকে আমাদের চেনাজানা জগতের বাইরের ঘটনা ছাড়া এক্সপ্লেইন করা যায় না। জানি এই কথাটা শুনে হয়তো আপনারা আমাকে অশিক্ষিত গাঁইয়া ভূত ভাববেন, সেটাই স্বাভাবিক। কিন্তু আমার দৃঢ় বিশ্বাস এটা বোধহয় আমাদের চেনা পৃথিবীর জাগতিক নিয়মকানুনের বাইরের অতিলৌকিক কিছু একটা ব্যাপার। কোনও ইনফেকশন, সে যতই মারাত্মক হোক না কেন, একদিনের মধ্যে রুগিকে এই অবস্থায় নিয়ে আসতে পারে না। আরও অনেক টেকনিক্যাল টার্ম বলতে পারি, যেগুলো বললে হয়তো আপনারা বুঝবেন না। তারা কিন্তু যা ঈঙ্গিত করছে, তাতে আমার বিশ্বাসটাই বদ্ধমূল হচ্ছে।
কী বলতে চাইছ সেটা একটু খুলে বলবে পিটারদা? কান্না ভেজা গলায় জিগ্যেস করল দীপাঞ্জন।
‘দ্যাখ ভাই, সোজা কথা বলছি, আমার মনে হচ্ছে তোর দিদির যা অবস্থা দেখছি, তাতে এটা কোনও স্বাভাবিক ইনফেকশন বা সেইরকম কিছু ভাবতে আমার অসুবিধা আছে। কয়েক ঘণ্টার মধ্যে বেশ কিছু প্যারামিটার এতটাই নেমে গেছে যে, কারেন্ট মেডিক্যাল সায়েন্স দিয়ে সেসব এক্সপ্লেইন করা যাচ্ছে না। আমার কাছে এখন চ্যালেঞ্জ নেক্সট তিন থেকে চার ঘণ্টার মধ্যে এঁকে অন্তত কলকাতা যাওয়ার মতো সুস্থ করে তোলা। নইলে যে রেটে ভাইটাল সাইনগুলো ফল করছে তাতে এই রাতটা কাটা মুশকিল। আমার বিদ্যায় এমন কোনও ওষুধ নেই যা এই অসাধ্যসাধন করতে পারে। এক যদি না…।
আমার বুকের ভিতরটা ফাঁকা হয়ে গেছিল, সেই অবস্থাতেই ক্ষীণ গলায় জিগ্যেস করলাম, এক যদি না কী, পিটারদা?
আমার আর দীপাঞ্জনের দিকে একবার বড় বড় করে চোখ মেলে তাকাল সেই নবীন ডাক্তারটি, তারপর গলাটা খানিকটা নীচু করে বলল, ‘একটা শেষ চেষ্টা করে দেখছি দীপান্বিতা, জানি না সফল হব কি না।
কী চেষ্টা পিটারদা? জিগ্যেস করতে বাধ্য হলাম।
আমাদের পরিবারে কিছু চালু আদিম চিকিৎসা পদ্ধতির প্রচলন আছে, বুঝলে। এইসব চিকিৎসা পদ্ধতি বেশ কয়েক হাজার বছরের পুরোনো। বংশানুক্রমে এসব গুপ্তবিদ্যা আমাদের ফ্যামিলিতে চলে আসছে। আমি জেনেছি আমার বাবার কাছ থেকে। তিনি জেনেছিলেন তাঁর বাবার কাছ থেকে। বাড়ির ছেলেরাই একমাত্র এই জ্ঞানের ন্যায্য অধিকারী হয়।
এই চিকিৎসা পদ্ধতির মধ্যে আছে বেশ কিছু মন্ত্র আর ওষুধ। সব ওষুধই হার্বাল, মানে এই জঙ্গলেই পাওয়া যায় এমন লতাপাতা দিয়ে তৈরি। জানি তোমরা শুনলে হয়তো নাক সিঁটকোবে, আমাকে গেঁয়ো ভূত ঠাওরাবে। কিন্তু ছোটবেলায় আমার বাবাকে দেখেছি এইসব ওষুধপাতি দিয়ে অবিশ্বাস্য সব ভেলকি দেখাতে। শ্মশানের পথে রওনা দেবে দেবে করছে, এমন লোককেও দেখেছি বাবার দেওয়া ওষুধ দু’ফোঁটা খেয়ে উঠে বসতে।
কিছু কিছু বিষকাটানের ওষুধ আর মন্ত্রটন্ত্র আমার বাবা আমাকে শিখিয়ে গেছিলেন। আজ তারই মধ্যে সবচেয়ে সাংঘাতিক, সবচেয়ে জটিল যে ওষুধটি, তারই জিনিসপত্র আনতে পাঠিয়েছি জোশুয়াকে। যদি আমার ছোটবেলায় শেখা বিদ্যা একেবারে ব্যর্থ না হয়ে থাকে, তবে আশা করি অন্তত কয়েকঘণ্টা এনাকে আমি বাঁচিয়ে রাখতে পারব, সে যতবড় বিষক্রিয়াই হোক না কেন।’ খুবই গম্ভীর শোনাচ্ছিল পিটারের গলার স্বর।
আমার সব কিছু ফের গুলিয়ে গেল। কে কোথাকার ডাক্তার, কার্যগতিকে এখানে এসে উপস্থিত হয়েছে, তার মুখে এসব হাজার বছরের পুরোনো কোন ‘বিষকাটানের ওষুধ’-এর কথা শুনছি? এসব তুকতাক বিষয়ে আমার কোনওদিনই কোনও ইন্টারেস্ট ছিল না। কিন্তু এই মুহূর্তে আমার কী করা উচিত সেটা একদমই বুঝতে পারছি না!
ব্যাপারটা ঠিক করে বোঝার আগেই রেংতা আর মংলাদা এসে আমাকে বারান্দার একদিকে টেনে নিয়ে এল। ওদের মুখচোখ দেখেই বুঝলাম যে, দুজনে কিছু একটা প্ল্যান করেছে, দুজনেরই গম্ভীর মুখে খেলা করে বেড়াচ্ছে একটা চাপা উত্তেজনা।’
পিসি একটু থামলেন, জল খেলেন। তারপর গলাটা একবার পরিষ্কার করে ফের শুরু করলেন।