কথাটা যে আমাদের খুবই চিন্তায় ফেলে দিয়েছিল সেটা বিস্তারিত না বললেও চলে। আমার টুটাফুটা কাজ চালানো গোছের ফার্স্ট এইড, আর বরাভূম স্টেশনের মেডিসিন স্টোর থেকে কিনে আনা কিছু ব্যথা কমানোর ওষুধ, এই নিয়ে মেয়েটার কতটাই বা আর চিকিৎসা করা যায়? স্থানীয় স্বাস্থ্যকেন্দ্র একেই এখান থেকে বেশ খানিকটা দূর, তার ওপরে সেখানে কীরকম কী চিকিৎসা পাওয়া যাবে তার কোনও ঠিক ঠিকানা নেই। ফলে ট্রেনের জন্যে বুকে পাথর বেঁধে অপেক্ষা করা ছাড়া আর উপায় কী?
দুপুর নাগাদ মনে হল এ যাত্রা বোধহয় মেয়েটাকে আর বাঁচানো গেল না। একশো তিন ডিগ্রি জ্বর আর অসহ্য পেটব্যথার সঙ্গে শুরু হল রক্তবমি। আর সে কী ভয়ানক রক্তবমি! মনে হল মেয়েটার পেটের মধ্যে থেকে যেন থকথকে কাদার মতো কালো রক্ত উঠে আসছে ভলকে ভলকে। যেমন বীভৎস তার রং, তেমনই উৎকট তার দুর্গন্ধ, পেটের নাড়িভুঁড়ি উঠে আসে প্রায়। ওকে সামলাতে গিয়ে আমারই বমি হল বারদুয়েক। বমিটমি করে আরও নেতিয়ে গেল। তারপর একটা ব্যথার ওষুধ খেয়ে সামান্য শুয়েছে মেয়েটা। আমি আর দীপাঞ্জন দুজনে কাহিল হয়ে সামনের বারান্দায় বসে আলোচনা করছি যে কখন ট্রেন চলাচল চালু হতে পারে, আর চালু হলে কী করে স্টেশন অবধি মেয়েটাকে নিয়ে যাওয়া যাবে, এমন সময় শুনি গেটের বাইরে টেম্পোর প্যাঁ-পোঁ আওয়াজ।
এ আওয়াজ আমার খুব চেনা। এটা বুধনদা’র টেম্পোর আওয়াজ।
আমি তো অবাক, তেমনই আশ্চর্য! এই এত বৃষ্টির পরেও, এইরকম অবস্থার মধ্যে লোকটা এল কী করে? তবে প্রথমেই যেটা মাথায় এল সেটা হচ্ছে যে বুধনদা হল গিয়ে এই এলাকার বহু পুরোনো লোক। কিছু না কিছু একটা ব্যবস্থা হয়েই যাবে নিশ্চয়ই। ডুবন্ত মানুষ যেভাবে খড়কুটো আঁকড়ে ধরে, ঠিক সেইভাবে আমি আর দীপাঞ্জন প্রায় পড়িমরি করে দৌড়ে গেলাম গেটের দিকে। আর গিয়েই দেখি বুধনদা একা আসেনি! এই ঘোর সঙ্কট সময়ে সে সঙ্গে করে নিয়ে এসেছে আরও দুজনকে!
সেই দুজনেই অবশ্য এখানকার লোক। পরনে যদিও বাহারি শহুরে পোশাক, দেখলেই বোঝা যায় যে তারা কলকাত্তাই আদবকায়দায় অভ্যস্ত। তাদের দেখে তো আমি যেমন অবাক তেমন বিব্রত। মহুয়ার এই অবস্থায় কোনও গেস্টকে এন্টারটেইন করার কথা আমি ভাবতেই পারি না। আর এতসব বৃষ্টিবাদল পেরিয়ে এখানে এরা এল কেন? কীভাবেই বা এল?
আহা, তখন যদি জানতাম যে শেষতক এদেরই একজন আমাদের দুঃখত্রাতা শ্রীমধুসূদন হয়ে দাঁড়াবে!
তাদের মধ্যে যাকে দেখেই দীপাঞ্জন দৌড়ে গেল জড়িয়ে ধরবে বলে, তার নাম জোশুয়া, জোশুয়া হেমব্রম, ওর কলেজের বন্ধু। আর সঙ্গের ছেলেটা জোশুয়ার দাদা পিটার, পিটার হেমব্রম। দীপাঞ্জনই আলাপ করিয়ে দিয়েছিল আমাদের। ওর মুখেই শুনলাম যে পিটার আর জি করে ডাক্তারি পড়তো। সবে পাশ করে, হাউস সার্জেনশিপ শুরু করেছে।’
‘এই কী সেই পিটার হেমব্রম যার কথা তুমি প্রথমে বলেছিলে? সেই যার পারিবারিক গল্পগাথা শুনে…’ কম কথা বললে কী হবে, অরিজিৎ ওরফে অ্যারির মেমরি যে অত্যন্ত শার্প সে কথা মানতেই হবে।
বেশ খানিকটা অন্যমনস্ক ভাবে মাথা নাড়লেন পিসি। মনে হল কী যেন একটা মনে করার চেষ্টা করছেন। তারপর ফের বলতে শুরু করলেন।
আমরা ওদের নিয়ে বারান্দায় এসে বসতেই রেংতা কোথা থেকে উদয় হয়ে হাঁউমাঁউ করে সাঁওতালি ভাষায় কীসব বলতে লাগল, আমরা তার বিন্দুবিসর্গ বুঝলাম না। শুধু বুঝলাম যে বাচ্চা বাচ্চা ছেলেমেয়েগুলোর অবস্থা দেখে সে ভারি চিন্তিত হয়ে পড়েছে, এবং সে আশা করছে যে এইবার কিছু অন্তত সুরাহা হবে। রেংতাকে একটু চায়ের ব্যবস্থা করতে বলে আমরা পুরো ব্যপারটা খুলে বলা শুরু করলাম। এরপর আমাদের সমস্ত বিপদ বিস্তারিতভাবে বলতে লাগল ঠিক চার মিনিট। আর ছ’মিনিটের মাথায় পিটার লেগে পড়ল মৃতপ্রায় মহুয়ার পরিচর্যা করতে। এখানে বলে রাখি যে, পিটার তার ডাক্তারি ব্যাগটি নিয়ে আসতে ভোলেনি। ঘরের ভেতর পিটার উদ্বিগ্ন মুখে মহুয়ার পরিচর্যা করছে, আর বাইরের বারান্দায় দাঁড়িয়ে জোশুয়া বলতে লাগল যে ঠিক এখনই এরা এখানে এল কী করে।
আগেই বলেছি যে, দীপাঞ্জন বেশ খানিকটা কসরৎ করেই এই বাংলোতে তিনদিন থাকার অনুমতি জোগাড় করেছিল। এই জোশুয়ার বাবা হচ্ছেন স্টেট ট্যুরিজম ডিপার্টমেন্টের উচ্চপদস্থ করণিক। জোশুয়ার বাবাকে ধরেই যে এই মহার্ঘ অনুমতিটি আদায় হয়েছিল সেটা আন্দাজ করতে বেশি কষ্ট করতে হয় না। জোশুয়ার দেশের বাড়ি বা গ্রামের বাড়ি, সেটা আবার আমাদের বুধনদার গাঁয়ে। এরা দুইভাই উইকেন্ডের ছুটি কাটাতে এসেছিল গ্রামের বাড়িতে। আর এসে দেখে এই বিপর্যয়!
কাল রাতের প্রবল বৃষ্টি দেখে বুধনদাও যেমন চিন্তিত হয়েছে আমাদের কী হাল হল সে নিয়ে, এরাও তেমনই চিন্তিত হয়েছে, কারণ জোশুয়া জানতোই যে আমরা কোথায় আছি। গ্রামেগঞ্জে সবাই সবার খবর রাখে। ফলে দুপুরের দিকে জল একটু সরতে দেখে যেই না বুধন’দা টেম্পো নিয়ে বেরিয়েছে এখানে আসবে বলে, এরাও বেরিয়ে পড়েছে সঙ্গে-সঙ্গেই। ওদের গ্রাম থেকে এখানে আসতে যেতে প্রায় দু’ঘণ্টার রাস্তা। সেটা আজকে পেরোতে ওদের লেগেছে পাঁচ ঘণ্টার কিছু বেশি।’