অনেক কষ্টে শেষরাতে মহুয়াকে ঘুম পাড়াবার চেষ্টা করলাম একবার। মাঝখানে একবার ভাবলাম এই ঘুমোল বুঝি। কিন্তু কোথায় কী? বিছানায় কোমরটা একটু ঠেকিয়েছি মাত্র, এমন সময় দেখি ঘুমিয়ে ঘুমিয়েই আর্তস্বরে চিৎকার করছে মেয়েটা, ও কারা এল, কারা এল রে! ওরে কুঠার বার কর, ওরা সাদাদের সেপাই, ওরে কে কোথায় আছিস…দৌড়ে আয় রে মরদের বাচ্চারা…আন টাঙ্গি…মার ওদের..’
গলাটা ওর নিজের নয়! আর ভাষাটাও বাংলা নয়…বাংলা মেশানো মানভূমের ভাষা!
ধড়মড় করে উঠে বসলাম আমি। দেখি দীপাঞ্জনও উঠে বসেছে। আমি ওর বিছানায় গিয়ে সোজা চেপে ধরলাম ওকে, আর আমার দুটো হাত যেন সঙ্গে সঙ্গে জ্বলে গেল। দেখি তীব্র জ্বরে ওর সারা দেহ পুড়ে যাচ্ছে আগুনের মতো! আর ঠিক তখনই হঠাৎ করে কী যেন হল, মনে হল কেউ যেন একটা বর্শা চালিয়ে দিয়েছে ওর পেট বরাবর। একবার ওঁক করে থরথরি কেঁপে উঠল মেয়েটা, আর তারপরেই চোখের মণিদুটো উলটে গেল, বুঝলি? মানে জাস্ট উলটে গেল! দেহটা ধনুকের মতো বেঁকে আছে, মাথাটা অল্প পেছনে ঝোঁকানো, ড্যাবড্যাব করে খোলা চোখদুটো জুড়ে শুধু চোখের সাদা অংশটা, আর তার ঠিক পরে পরেই অন্য একটা ঘষা পুরুষালি গলায় ত্রু«দ্ধস্বরে সাঁওতালি ভাষায় কীসব যেন বলতে শুরু করল মহুয়া!
সেই গলা শুনে আমার শিরদাঁড়া দিয়ে ভয়ের একটা ঠান্ডা স্রোত নেমে গেল। এ কোন মহুয়া? এই এতদিনের চেনা মেয়েটার শরীরে এ কার গলা?
মহুয়া তখন ওর পা দুটো বিছানায় আছড়াচ্ছে কাটা পাঁঠার মতো। সাপের মতো দীর্ঘ হাত আর পা দিয়ে জাপটে ধরেছে আমাকে, আঁকড়ে ধরেছে আমার চুল আর পিঠের জামা। নখগুলো ছুরির মতো বিঁধছে আমার সারা গায়ে। আর সেই ভয় জাগানো অজানা পুরুষালি গলায়, স্যাঁওতালি ভাষায় কাকে যেন কিছু অভিশম্পাত করে চলেছে সে।
বুঝতে পারছি না, আমি জাস্ট বুঝতে পারছি না যে আমার কী করা উচিত!
এমন সময় অসাধ্যসাধন করল দীপাঞ্জন। দৌড়ে এসে আমাকে একঝটকায় সরিয়ে দিয়ে নিজের দিদির ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে আর্তস্বরে চিৎকার করে উঠল ছেলেটা—দিদি রে, অমন করিস না রে দিদি। আমি তো আছি রে দিদি…অমন করিস না আমার যে ভয় লাগে রে দিদি…’ বলে দু’হাত দিয়ে সেই ছেলেটা হাউহাউ করে কাঁদতে কাঁদতে জড়িয়ে ধরল তার একমাত্র সহোদরাকে।
ভালোবাসার কী অপার মহিমা। চোখদুটো একবার বন্ধ করে খুলল মহুয়া, দেখলাম চোখের মণি আবার স্বস্থানে। সেই লাল লাল জ্বরচোখ মেলে মাত্র একবার দীপাঞ্জনের দিকে চাইল, আর তার কিছুক্ষণের মধ্যেই গভীর ঘুমে ঢলে পড়ল মেয়েটা। আমিও হাঁপ ছেড়ে একটু নিশ্চিন্ত হয়ে ঘুমোবার অবসর পেলাম।
পরের দিন ঘুম থেকে উঠে বুঝলাম যে, আক্ষরিক অর্থেই অথৈ জলে পড়েছি। কাল রাতের বৃষ্টিতে চারিদিক জলে থই-থই করছে। বারান্দায় দাঁড়ালে দেখা যাচ্ছে যে কাল রাত্রের বৃষ্টিতে অযোধ্যা পাহাড়ের জঙ্গলের কী উথালপাতাল অবস্থাটাই না হয়েছে। আকাশ যদিও পরিষ্কার, কিন্তু বাতাসে শীতের কামড় বড় তীব্র হয়ে উঠেছে এই একরাতেই। রেশন যা এনেছি তাতে হয়তো আরও দিন দুয়েক চলে যাবে, কিন্তু কথা হচ্ছে যে মহুয়াকে নিয়ে বরাভূম স্টেশন অবধি পৌঁছব কী করে?
সকালবেলা মহুয়াকে তুলতে গিয়ে দেখি একরাত্রেই মেয়েটার শরীর যেন ভেঙে পড়েছে আরও। নিঃসাড় আর নির্জীব ঘোলাটে দুচোখে ফ্যালফ্যালে দৃষ্টি, রুখুসুখু চুলগুলো উড়ছে পাগলির মতো। এই একরাতেই অমন চাঁপাকলির মতো আঙুলগুলো শুকিয়ে কালো দড়ির মতো হয়ে গেছে। দেখলে মনে হচ্ছে যে চাপচাপ কালশিটে পড়েছে দুই হাত জুড়ে। অমন সুন্দর হাত দুটোর দিকে চাইতে আমার ভয়ই করছিল।
সকালে মহুয়াকে অতি কষ্টে একটা ব্রেড জ্যাম খাইয়েছি। মেয়েটার মুখের দিকে তাকানো যাচ্ছে না। জ্বর, কষ্ট, এসব বাদ দিয়েও বোঝা যাচ্ছিল যে পেটের অসহ্য ব্যথাটা পাগল করে তুলছে ওকে, ওর গায়ে আর কষ্ট সহ্য করার কোনও শক্তিই অবশিষ্ট নেই। ওকে দেখে আমার থেকে থেকে চোখ ফেটে জল আসছিল। শুধু মনে মনে প্রার্থনা করছিলাম, হে ঠাকুর, ভালোয় ভালোয় মেয়েটাকে কলকাতা নিয়ে যেতে দাও।
কিন্তু ঠাকুর কথাটা শুনলেন না।
সকাল সকাল মংলাদা এসে গেছিল। ওর মুখেই শুনেছিলাম রাস্তায় পড়ে থাকা গাছের ডালপালা, মরা কুকুর বেড়াল আর পাখির ছানা ইত্যাদি সরিয়ে কত কষ্টে আজ আসতে পেরেছে সে। পুরুলিয়াতে এরকম বৃষ্টি নাকি বহুদিনের মধ্যে কেউ দেখেনি। গ্রামের দিকে অবস্থা নাকি আরও খারাপ। অনেক বাড়ির মাটির দেওয়াল ধ্বসে পড়েছে, মারা গেছে বেশ কিছু হাঁস মুরগি আর ছাগল। সাপে কেটে মারা গেছে একজন, গাছের ডাল মাথায় পড়ে আহত বেশ কিছু। এখনও অনেক জায়গাতেই জল জমে আছে।
দীপাঞ্জন ব্রেকফাস্টের নামে নাকেমুখে দুটো গুঁজেই মংলাদা’কে নিয়ে বেরিয়ে গেল বরাভূম স্টেশনের দিকে, কলকাতাগামী যে কোনও ট্রেনের তিনটে টিকেট কাটার জন্যে। কিন্তু বেলা সাড়ে এগারোটা নাগাদ ওরা যখন ফিরে এল তখন বুঝলাম যে পরিস্থিতি যতটা ভেবেছিলাম তার থেকেও অনেক খারাপ। কাল রাতের প্রবল বৃষ্টিতে অনেক জায়গায় লাইনের ওপর জল জমে গেছে, ট্রেন চলাচল আপাতত বন্ধ। অনেক ট্রেন বিভিন্ন স্টেশনে দাঁড়িয়ে আছে। আশা করা যাচ্ছে, বিকেলের দিকে জল নেমে গেলে ট্রেন চলাচল আবার স্বাভাবিক হবে। তবে সেও কথার কথা, মানে হলে হবে, এইমাত্র। তার কোনও নিশ্চয়তা নেই।