‘পরদিন ভোরবেলা ঘুম ভেঙে উঠে দেখি মহুয়া আগেই উঠে পড়েছে। আমার বিছানার উল্টোদিকের দেওয়ালেই একটা বিশাল জানলা ছিল। মহুয়া দেখি সেই জানলার সামনে আমার দিকে পিঠ ফিরিয়ে দাঁড়িয়ে, নাকমুখ গ্রিলে ঠেকিয়ে রেখেছে। আমি হাই তুলতে তুলতে বললাম, কী রে মৌ, কখন উঠলি ঘুম থেকে? জবাবে মহুয়া আমার দিকে ফিরে একটা ঘর আলো করা স্মাইল দিয়ে জানলাটা ছেড়ে দাঁড়াল। আর আমার নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসার উপক্রম প্রায়!
অযোধ্যা পাহাড়টা যে এত কাছে সেটা কাল বুঝিনি। গত রাতে বোধহয় একচোট বৃষ্টি হয়ে গেছে, শীতের বাতাসে একটা ঠান্ডা ফ্রেশ ফ্রেশ ভাব। আর নীল ঝকঝকে আকাশ জুড়ে কালচে সবুজ আর গেরুয়া রং মেখে দাঁড়িয়ে আছে অযোধ্যা পাহাড়। হেমন্তের শেষে হলুদ পাতায় সাজানো সেই পাহাড়ি বন কী মায়াঘোরই না বিছিয়ে রেখেছে। আকাশে উড়ছে নাম না জানা পাখিদের দল। আমাদের বাংলোর বারান্দার পরেই সাজানো বাগান, আর এই পুরো বাংলো ঘিরে আছে শক্ত শালবল্লার বেড়া। বেড়ার ওপার থেকেই শুরু মেঠো জঙ্গুলে পথ, ঝরাপাতা বেছানো সেই পথ ধীরে ধীরে মিশেছে ঘন বনের মধ্যে। সব মিলিয়ে পুরো দৃশ্যটা ঠিক যেন আমাদের ছোটবেলার আর্চিসের গ্রীটিংস কার্ডে আঁকা ছবি একখানা।
আমি উঠে এসে ঘরের দরজা খুলে বারান্দায় গিয়ে দাঁড়াতেই আরেক চমক! বারান্দা থেকে একদম সামনেই অযোধ্যা পাহাড়, আর বারান্দার একদম ডানকোণে গিয়ে ঘাড় ঘোরালেই দূরে দেখা যাচ্ছে দলমা পাহাড়ের রেঞ্জ! সে এক অদ্ভুত দৃশ্য, বুঝলি! ভাষায় বোঝাতে পারবো না। বাংলোর বাইরেটায় মনে হচ্ছে কে যেন সবজে হলদে কার্পেট পেতে দিয়েছে, আর তার ওপর টুপটাপ করে এসে পড়ছে বড় বড় শালপাতা। ঝলকে ঝলকে মনমাতানো ঠান্ডা বাতাস আর তার সঙ্গে মেশানো একটা বুনো গন্ধ আমাদের নাকে এসে লাগতেই মনে হল আহ, মাত্র তিনদিন কেন? আরও কয়েকদিন থেকে যাই না কেন এখানে?
রেংতার হাতে বানানো দুর্দান্ত ভালো রুটি সবজি আর ডিমসিদ্ধ খেয়ে আমরা তিনজনে যখন তৈরি তখনই বাইরে টেম্পোর হর্ণ। দেখি বুধনদা’র দেখে দেওয়া আরেক গাড়িওয়ালা মংলা’দা তার টেম্পো নিয়ে এসে হাজির। দেখে আমাদের তো খুশি আর ধরে না। একটা বেতের বাস্কেটে রেংতার বানানো লাঞ্চ নিয়ে রওনা হতে আমাদের লাগল ঠিক দশ মিনিট। তারপর টেম্পো চলল অযোধ্যা পাহাড়ের দিকে।
রাস্তার সিনিক বিউটির বর্ণনা দিয়ে আর তোদের হিংসে বাড়াব না। শুধু একবার বলব যে প্রথম যখন স্কটিশ হাইল্যান্ড দেখি, তখনও ঠিক এইরকমই অনুভূতি হয়েছিল। এই শীতে তোরা বন্ধুরা মিলে ঘুরে আয় না একবার। এখন অবশ্য রাজ্যের ট্যুরিস্টরা গিয়ে তার কী হাল করেছে বলতে পারব না।
সে যাই হোক, লোয়ার ড্যাম আপার ড্যাম পেরিয়ে যখন বামনী ফলস পৌঁছই তখনই বেশ দেরি হয়ে গেছিল। সকালের হেবি ব্রেকফাস্ট তখন পেটের মধ্যে কোথায় যে তলিয়ে গেছে তার ঠিকঠিকানা নেই। রাস্তা থেকে প্রায় তিনশো মিটার নীচে নামলে বামনী ফলস। তরতর করে পাথুরে পথ সামলে নেমে তো গেলুম, তারপর সেখানে ঘণ্টাখানেক কাটাবার পর উঠে আসতে সে যে কী কষ্ট তা আর কী বলব!
তারপর গেলুম তুর্গা ড্যাম। সেখানে দাঁড়িয়ে চারিদিক দেখে তো আমরা মোহিত। দীপাঞ্জন তো হাতফাত নেড়ে হেঁড়ে গলায় ”ভারত আমার ভারতবর্ষ” ইত্যাদি গেয়েটেয়ে একশা! আমরা সেখানেই রেংতার বানানো অসম্ভব ভালো ঝাল ঝাল চিকেন কারি, রুটি আর জিলিপি দিয়ে লাঞ্চ সেরে নিলাম।
নীচে নেমে এসে এসে মংলা’কে এরপর কোথায় যাব জিগ্যেস করাতে যখন শুনলাম যে, এরপর আমাদের গন্তব্য দুয়াসিনির হাট, তখন সারাদিনের ক্লান্তি সত্ত্বেও আমি আর মহুয়া ভারি আহ্লাদে নেচে উঠলাম। এই এলাকার গ্রামের হাট মানেই লাক্ষার তৈরি দারুণ দারুণ সব ভালো জাঙ্ক জ্যুয়েলারি তো আছেই, তাছাড়া সাঁওতালদের তৈরি খুব ভালো ভালো হ্যান্ডিক্রাফটস পাওয়া যায়। কাছেই চড়িদা গ্রাম, ছৌ নাচের মুখোশ তৈরি করার জন্যে সারা পৃথিবীবিখ্যাত। আমরা দুই সখি তো শুনেই খুব চনমনে, দীপাঞ্জন মিনমিন করে ‘আজ খুব রাত হয়ে যাবে’ ইত্যাদি টাইপের অজুহাত দিলেও বিন্দুমাত্র পাত্তা দিইনি। মংলাদা’কে বললাম চল দুয়াসিনি।
সেই দুয়াসিনির হাটেই একটা অদ্ভুত ঘটনা ঘটল, যেখান থেকে আমাদের কাহিনি শুরু।
আমরা তিনজনে হাটে ঘুরে বেড়াচ্ছি। আর পাঁচটা আদিবাসী হাট যেমন হয় এটাও সেরকমই। মাটিতে প্লাস্টিকের তেরপল বিছিয়ে লোক্যাল আর্টিফ্যাক্টসের জিনিস আর তার সঙ্গে কাঁচা তরিতরকারি, স্থানীয় খাবারদাবার, ইত্যাদির দোকান। হাটের পেছনদিকটায় হাঁড়িয়া আর মহুয়ার ঠেক, তার উগ্রগন্ধে বাতাস ভারী হয়ে আছে।
মহুয়া আবার জাঙ্ক জুয়েলারির নামে পাগল, তাকে দেখে সেই ড্যাঞ্চিবাবুদের কথা মনে পড়ে যাচ্ছে আর কী। আমাদের কেনাকাটা শেষ হওয়ার পরেও ওকে দেখে মনে হচ্ছে তার মার্কেটিং-এর আশ এখনও মেটেনি, পারলে এই দুয়াসিনির হাটের একটা অংশ সে কলকাতাতেই নিয়ে যায়!
মহুয়াকে জোরজার করে টেনে আমরা বেরিয়ে আসব, এমন সময় দেখি বেরোনোর রাস্তার মুখেই ছোট্ট একটা ঘুগনির ডালা নিয়ে একটা ঘুগনিওয়ালা বসে আছে।
এখানে বলে রাখি যে, আমাদের কলেজের ‘ঘুগনি ও ফুচকাপ্রেমী সমিতি’-র প্রেসিডেন্ট ছিল মহুয়া। যে কোনও জায়গায়, যে কোনও পরিস্থিতিতে দু’প্লেট ঘুগনি বা খান বিশেক ফুচকা উড়িয়ে দেওয়া ওর কাছে কোনও ব্যাপারই ছিল না। সে তো হাসিমুখে গিয়ে দাদা, দু’প্লেট ঘুগনি দাও তো! বলে স্ট্রেট দাঁড়িয়ে পড়ল।