‘আমাদের সমাজের কেউ নয় রে ডানবুড়ি। আমাদের সমাজের হলে কেটে রেখে আসতাম না সেই কুকুরটাকে? ওদের ধরিয়ে দিয়েছে একটা দিকু, বাঙালি দিকু।
‘নাম বল রে বেদিয়া, কে করেছে এই কাজ? কার জন্যে সিঙবোঙার অভিশাপ নেমে এল আমাদের সোনার বাছাদের মাথায়? গুণ করবো তাকে, মুখে রক্ত উঠে মরবে সে, এই বলে দিলাম রে বেদিয়া। মারাংবুরুর বুক খুঁড়ে আমরা এই তিন ডাইনি বোন তুলে এনেছি কালিয়া মাসানের বিষ। এ দিগরে না আছে আমাদের কোনও আটকান, না আছে কোনও বাঁধন। বল রে বেদিয়া, কে করেছে এই কাজ। তার বুকে ঢেলে দিই কালিয়া মাসানের বিষ। তার সবকিছু জ্বলে ছাই হয়ে যাক।’ তৃতীয় মহিলার চোখে ধ্বক করে জ্বলে উঠল রাজগোখরো’র বিষ।
এরপর চুপ করে থাকে সবাই। কাঠকুটোর আগুন বেশ খানিকটা স্তিমিত হয়ে এসেছে তখন। অল্প আঁচের আভা বিছিয়ে ছিল তাদের সবার চোখেমুখে। সেই অনন্ত মৌনতা ভেঙে মুখ খোলেন পুরুষটি।
‘পারাণিক আর গডেতরা লুকিয়েচুরিয়ে খবর এনেছে শহর থেকে। এ কাজ করেছে শাহদেও রাজপরিবারের নায়েব। অনেকে টাকা খেয়েছে রে ডানবুড়ি, অনেক টাকা খেয়েছে লোকটা। তাতেও আশ মেটেনি শয়তানটার। তারপর আমার সিদোকে খেল, কানুকে খেল, লখাইকে খেল…’ আর বলতে পারে না লোকটা, কান্নার বেগে গলাটা বন্ধ হয়ে আসে। চুপ করে থাকে বাকিরা।
‘তাদের দেহগুলোর কী হল রে? জানিস কিছু?’ প্রশ্ন করেন প্রবীণতম বৃদ্ধাটি।
‘লুকিয়ে চুরিয়ে ওদের দেহগুলো আমরা নিয়ে গেছিলাম দলমা’র জঙ্গলে। ওদের ওখানেই জ্বালিয়ে দিয়েছি। এই দেখ ডানবুড়ি,’ এই বলে গেঁজে থেকে একটা কাপড়ের পুঁটলি বার করেন সেই শোকাহত মানুষটি। ‘এই দেখ আমার লখাইপোড়া ছাই। অমন পাহাড়ের মতো মস্ত ছেলেটা আমার এই এত্তটুকু ছাই হয়ে গেল রে বুড়ি। ওরে আমার যে আর কেউ রইল না রে, আমার ঘর রইল না, বাহির রইল না। লখাই রূপাই যে আমার দুটো বুকের পাঁজর ছিল রে, জোয়ান ছেলেদুটো আমার। আমার যে আর কেউ রইল না বুড়ি, কিছু রইল না।’ এই বলে বুক চাপড়ে হাউ হাউ করে কেঁদে ওঠে মানুষটি।
সমস্ত জঙ্গল যেন শিউরে উঠল সেই কান্না শুনে। মস্ত শালপিয়ালের বন জুড়ে, বিশাল অযোধ্যা পাহাড়ের বুক চিরে, মাথার ওপর অনন্ত আকাশের শেষ প্রান্ত পর্যন্ত যেন কেউ ঘুরে ঘুরে কাঁদতে লাগল, ‘আমার আর কেউ রইল না, কিছু রইল না।’ বাতাসে পরতে পরতে ঘুঙুরের আওয়াজের মতো জড়িয়ে গেল সেই কান্না, ‘আমার আর কেউ রইল না, কিছু রইল না।’ তারার আলোয়, মাটির ওমে, মহুয়ার ফুলে যেন কেউ উজাড় করে দিল তার বুকভাঙ্গা দুঃখের জল, ‘আমার আর কেউ রইলো না, কিছু রইল না।’
উঠে দাঁড়ান একজন বৃদ্ধা, হাত বাড়িয়ে পুঁটুলিটা হাতে নেন। পুঁটুলিটার ওপর বিড়বিড় করতে করতে করতে হাত বোলাতে থাকেন। তারপর বাকি দুই সঙ্গিনীর দিকে তাকিয়ে বলেন, ‘ওঠ রে ডাইনি বোনেরা আমার। জাগিয়ে তোল মারাংবুরুর রাগ। আয়, এই ছাইয়ে মিশিয়ে দিই কালিয়া মাসানের বিষ। আর শোন রে বেদিয়া, আমরা নেবো তোর চোখের মণি আর বুকপাঁজরের রক্ত। আর এই ছাইতে মিশিয়ে দেবে হাজার কালনাগিনীর গরল। যে করে হোক, এই ছাই তুলে দিস সেই বিশ্বাসঘাতক দিকুর মুখে। যে আমাদের বাছাদের ধরিয়ে দিয়েছে সেপাইদের হাতে, খুন করেছে আমাদের ছেলেদের, দু’দিনের মধ্যে মুখে রক্ত উঠে মরবে সে। মরবে অশেষ কষ্ট পেয়ে। তার বুক জ্বলে যাবে আগুনে, তার চোখ খুবলে খাবে নরকের দেও’রা। সে না পারবে জেগে থাকতে, না পারবে শান্তিতে ঘুমোতে। যত আবগে বোঙ্গা আছে দুনিয়াতে, তাদের ডেকে তোল রে বোনেরা। কালসিং আর গদরবোঙা নেমে আসুক সেই দিকুটার ওপর, সবাই মিলে চুষে খাক ওর রক্ত মাংস আর অস্থি মজ্জা।’
মানুষটা চুপচাপ বসেছিলেন। প্রবল শোকে তাঁর বুকের মধ্যে উথলে উঠেছে কান্নার ঢেউ। তাঁর কাছে এসবই অর্থহীন লাগছিল। নিস্তেজ স্বরে তিনি বলেন, ‘সে তো টাকাপয়সা নিয়ে কলকেতা না কোথায় চলে গেছে। তার ঠিকানা কেউ জানে না। তার কাছে পৌঁছব কী করে?’
তারপর সেই তিন ডাইনিবুড়ি আরও ঘন হয়ে আসে, ‘পাবি রে বেদিয়া, তাকে পাবি। যতদিন না পাস, ততদিনে তুই খুঁজে বেড়াবি সেই শয়তানটাকে। শোনরে ছেলে, তোকেও জাদুটোনা করব আমরা। এই রক্তবিষের কাটান হতে পারে শুধু তোর নিজের রক্ত। তাই তোর এই রক্তমাংসের দেহ নিয়ে নেব আমরা, যাতে করে এই বিষের কোনও জবাব না থাকে। তার বদলে তোকে আমরা দেব ছাইয়ের দেহ, ছাইয়ের জীবন। খুঁজে বেড়াবি সেই দিকুকে, জনমভোর। সে না হোক তার ছেলে, তার ছেলে না হোক তারও ছেলে…কাউকে না কাউকে একদিন তুই খুঁজে পাবিই রে বেদিয়া। ততদিন তুই মরবি না, তোর ছাইয়ের দেহ থাকবে এমনই সুঠাম, এমনই সবল। ওই বিশ্বাসঘাতকের বংশের কারও না কারও বুকে এই কালিয়া মাসানের ছোবল না বসালে তোর মুক্তি নেই রে বেদিয়া, তোর মরণ নেই।’
এই বৃষ্টিভেজা অরণ্যরাত্রিতে, এই নিভন্ত আগুনের আঁচে, এই তিন ডাইনিবুড়ির কথায় সব গোলমাল হয়ে গেল মানুষটার। কার পাপে কার শাস্তি হয়? মানুষের পাপের ফল তার সন্তানদের ওপর অর্শায় কীসে? কতদিন থাকে পাপ আর পুণ্যের উত্তরাধিকার? কাকেই বা বলে পাপ, কাকেই বা বলে পুণ্য? কোনটা ন্যায় আর কোনটাই বা অন্যায়? ভালোই বা কী আর মন্দই বা কী? এসব বোধের থেকে অনেক দূরে চলে গেছিলেন তিনি, তাঁর চৈতন্য আর কাজ করছিল না তখন। ভূতগ্রস্তের মতো উঠে দাঁড়িয়ে তিনি বললেন, ‘তাই কর রে ডানবুড়িরা। বুকে বড় জ্বালা রে আমার, বড় জ্বালা। হা রে আমার লখাই..হা রে আমার রূপাই…’ দু’হাত আকাশের দিকে তুলে আবার হাহাকার করে কেঁদে উঠলেন তিনি।