সে যাকগে, মারিওনের ইউরোপীয় সৈন্যরা নিদারুণ আতঙ্কের মধ্যে দিন কাটাচ্ছিলো। কারণ প্রতি মুহূর্তে অভ্যুত্থানের নতুন নতুন গুজব তাঁদের কাছে আসছে। সব সময়েই তারা সেপাইদের অভ্যুত্থানের আশঙ্কা করছিলো। অবশেষে ৩০ তারিখে রাত্রি ন’টার সময় সেপাইরা সশস্ত্র বিদ্রোহ ঘোষণা করে। যদিও কয়েকটি প্রাণহানি হয়েছে, এখন পর্যন্ত ভয়াবহ কোনো যুদ্ধ অনুষ্ঠিত হয়নি। ১৩ এবং ৭১নং দেশীয় বাহিনীর দেশীয় সেপাইরা সে মুহূর্তেই ৩২নং ইউরোপীয় বাহিনীতে যোগদান করলো। ১৩নং বাহিনীর সেপাইদের একটি দল ক্যান্টনমেন্টে স্যার হেনরীর বাসভবন পাহারা দিতে বেষ্টনী রচনা করলো। শহরের রাস্তা একেবারে বন্ধ করে দেয়া হয়েছিলো, সে জন্য সেপাইরা সে দিকে একদম অগ্রসর হতে পারেনি। পরের দিন সামনের দিক থেকে সেপাইদের উপর আক্রমণ করা হলো, কিন্তু তারা কোনো রকমের বাধা না দিয়ে সরে পড়লো। শেষ পর্যন্ত দীর্ঘদিনের উৎকণ্ঠার অবসান ঘটলো। কারা বন্ধু এবং কারা শত্রু তা নির্দিষ্ট করে জানার উপায় নেই। শহরের একটি অভ্যুত্থান পুলিশের সাহায্যে অতি সহজে দমন করা সম্ভব হলো।
কোর্ট মার্শালে বন্দীদের বিচার করা হলো এবং তাদের অনেককেই ফাঁসিকাঠে ঝুলানো হলো। মচ্ছি-ভবনের সামনে এক সারি ফাঁসিকাঠ পোঁতা হলো এবং ৮০ পাউন্ড গুলি ছুঁড়তে সক্ষম একটি কামান বসানো হলো, যাতে করে সাহসী দুষ্কৃতিকারীরা কোনো সুবিধা করতে না পারে। কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হতে লাগলো, যে সকল সেপাইকে বিদ্রোহের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট দেখা যাচ্ছিলো, তারা অনেকেই চরম দণ্ড লাভ করেছিলো। বিদ্রোহীরা এবার দিল্লী অভিমুখে ধাওয়া করলো, কিন্তু রাজভক্ত সেপাইদের নিয়ে কি করা হবে-সে ব্যাপারে একটা সমস্যা দেখা দিলো। তাদের অনেকেই স্বেচ্ছায় ৩০শে মে-র অভ্যুত্থানে অংশগ্রহণ করেছে এবং পুরোনো সাথীদের সাথে হাত মিলিয়ে ফেলেছে। অর্থনৈতিক কমিশনার মর্টিন গাবিন্স দাবি করতে লাগলেন যে তাদেরকে নিরস্ত্র করে ফেলা হোক। কতেক ছাউনিতে অশুভ সংবাদ শুনে ইউরোপীয় অধিবাসীদের আতঙ্ক বেড়ে গেলো। কারণ অধিক পরিমাণে ভারতীয় সেপাই জড়ো করার ফলে ইউরোপীয় অধিবাসীরা ভারতীয়দের কৃপার পাত্র হয়ে পড়েছে। সুতরাং গাবিস তাদেরকে শক্তির বদলে দুর্বলতার উৎস বলে মনে করতে লাগলেন। তিনি বলেছেন, স্যার হেনরী লরেন্সও তার প্রস্তাবে প্রায় রাজী হয়ে এসেছিলেন। কিন্তু পরিস্থিতি এমনভাবে পরিবর্তিত হয়ে গেলো যে হঠাৎ করে কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করাও অসম্ভব হয়ে পড়লো। স্যার হেনরী দুর্বল মানুষ ছিলেন না। তিনি বুড়ো পেনশনভোগী সেপাইদের আহ্বান করলেন, আগুনের গোলার মুখে তারা আপন সতোর পরিচয় দিয়েছিলেন। গাবিন্সের যুক্তি হলো, নিশ্চিত অবস্থায় তাদেরকে সকল রকমে বিশ্বাস করা যায়। কিন্তু পরিস্থিতি এমন যে, একটু নড়চড় হলে ১২০০ লোকের তলোয়ার এবং সঙ্গিন তাদের বিপক্ষ দলে যাবে। সে জন্য এ সকল সেপাইদের নিরস্ত্র করে ফেলা হলে তাদের আর বিপদের কোনো আশঙ্কা থাকে না। গাবিন্সের সন্দেহ যে অমূলক, সে কথাও কিছুতে বলা যায় না। চিনহাটে গোলমাল দেখা দিয়েছে। কিন্তু এখনো পাঁচশো ভারতীয় সৈন্য কোম্পানীর পক্ষে লড়াই করছে। গাবিন্সের পরামর্শ মতো কার্যকর করা হলে ভারতীয় সেপাইরা এতো বড়ো অপমান মুখ বুজে সহ্য করতো কি না তা বলা যায় না। এমন কি স্থান পরিবর্তন ব্যতিরেকে সেপাইদের পিছু হটানো হলে সর্বনাশ হয়ে যেতো। কারণ যে সকল ইউরোপীয় সৈন্য সামরিক পোষ্টগুলো পাহারা দিচ্ছিলো, তাদের সংখ্যা ছিলো নিতান্তই অল্প। গাবিনস যদি যাত্রা করতেন তা হলে লখনৌর দশাও কানপুরের মতো হতো। অবরোধকৃত অঞ্চলসমূহে ভারতীয় সেপাইদের প্রতি সন্দেহ এবং অবিশ্বাসের দৃষ্টিপাতে তাকানো হচ্ছিলো।
লখনৌতে বিদ্রোহ সীমাবদ্ধ রইলো না, খুব শীগগির অযোধ্যার প্রান্তস্থিত সামরিক ঘাঁটিসমূহেও এ খবর ছড়িয়ে পড়লো। সেপাইদের কোনো পরিকল্পিত কর্মসূচি কিংবা সুচিন্তিত পন্থা ছিলো না। প্রত্যেক রেজিমেন্ট নিজ নিজ ইচ্ছা অনুসারে চলতে লাগলো। কোনো কোনো ব্যাপারে সরকারি ব্যবস্থার প্রতি যে সন্দেহ ছিলো তা ভয়ে পরিণত হলো এবং শীগগিরই দোদুল্যমান সেপাইরা সক্রিয় বিদ্রোহে অংশগ্রহণ করে।
শাসনকার্যের সুবিধার জন্য অযোধ্যা প্রদেশকে ৪টি বিভাগ এবং ১২টি জেলায় বিভক্ত করা হয়। ৩রা জুন তারিখে খয়েরপুর বিভাগের সামরিক দফতর সীতাপুরে গোলমাল আরম্ভ হয়। কমিশনার জে. জি. খ্ৰীষ্টিয়ান সাহেব ছিলেন কড়া মেজাজের লোক, অধীনস্থ কর্মচারি হিসাবে একদম বেমানান ছিলেন তিনি। তিনি অর্থনৈতিক কমিশনার মার্টিন গাবিন্সকে দু’চোখে দেখতে পারতেন না। সে জন্য কিছুতেই পুরোনো জমিদারদের সম্পূর্ণরূপে নির্মূল করার নীতি মেনে নিতে পারলেন না। তাঁর বিভাগের অবস্থা অন্যান্য অঞ্চলের চাইতে ভালো, কিন্তু শীগগির সংবাদ পাওয়া গেলো, জমিদারেরা তালুকহারা তালুকদারদের সঙ্গে মিলিত হতে শুরু করেছেন। সীতাপুরে ৪৮নং দেশীয় বাহিনী এবং অযোধ্যায় আরো দু’টি অনিয়মিত রেজিমেন্ট ছাউনি ফেললো। ৩০শে মে পর্যন্ত খ্রস্টিয়ান নিশ্চিত ছিলেন যে তিনি অনিয়মিত বাহিনীর উপর আস্থা রাখতে পারেন এবং এ বিভাগের জন্য চিন্তা করার কোনো কারণ নেই। প্রকৃত প্রস্তাবে ৪১নং দেশীয় বাহিনীর সেপাইরা লখনৌর বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে মার্চ করে দিল্লী অভিমুখে যাত্রা করে এবং বিদ্রোহী সেপাইদের বিরুদ্ধে গুলি বর্ষণ করে। তাদের সঙ্গে মেশার কোনো ইচ্ছে যে নেই তা গোপন করলো না তারা। সতর্কতার ব্যবস্থা স্বরূপ খ্রীস্টিয়ান সকল মহিলা এবং শিশুদের তাঁর বাঙলোতে এসে অবস্থান করতে আমন্ত্রণ জানালেন। প্রতিরক্ষার জন্য সেটা ছিলো খুবই উপযুক্ত স্থান, কিন্তু হঠাৎ করে সেখান থেকে পলায়ন করার কোনো উপায় ছিলো না। সাদা চামড়ার লোকেরা বাঙলোতে আশ্রয় নিয়েছে দেখে অনিয়মিত বাহিনীর লোকদের মনে সন্দেহের উদয় হলো। তারা মনে করলো অফিসারেরা তাদের অবিশ্বাস করতে শুরু করেছে। পরদিন সেপাইদের ছাউনিতে একটা গুজব রটলো, কোতোয়াল যে