- বইয়ের নামঃ সিপাহী যুদ্ধের ইতিহাস
- লেখকের নামঃ আহমদ ছফা
- প্রকাশনাঃ খান ব্রাদার্স অ্যান্ড কোম্পানি
- বিভাগসমূহঃ ইতিহাস
০. ভূমিকা ও সূচীপত্র
সিপাহী যুদ্ধের ইতিহাস – আহমদ ছফা
[রচনাকাল ১৯৬৫ থেকে ১৯৬৭ সাল। ১৯৭৯ সালে লেখাটি প্রথম বাংলাবাজারস্থ বুক সোসাইটি প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান থেকে প্রকাশিত হয়। এই রচনাটিকে ওই একই সালে বাংলাদেশ ইতিহাস পরিষদ পুরস্কার দিয়ে সম্মানিত করা হয়। সিপাহী যুদ্ধের ইতিহাসের পরবর্তী সংস্করণও বুক সোসাইটি থেকে প্রকাশিত হয় ১৯৮৭ সালে। তৃতীয় সংস্করণটি ১৯৯৬ সালে প্রতিপক্ষ প্রকাশনা থেকে প্রকাশিত হয়। ইতোমধ্যে কোলকাতার ইসলামী পাবলিকেশন্স সিপাহী যুদ্ধের ইতিহাসের একটি পশ্চিমবঙ্গীয় সংস্করণও প্রকাশ করেন।]
উৎসর্গ
পিতৃপ্রতিম উলানিয়ার পুণ্যশ্লোক মরহুম আরিফ চৌধুরী
এবং
অবহেলিত জ্ঞানতাপস অজাতশত্রু ইতিহাসবেত্তা প্রফেসর আগা মাহদী হুসেইন
এই দুই মহান ব্যক্তির নামে এই অপরিপাটি গ্রন্থটি উৎসর্গ করা হলো।
পরিচায়িকা
সমগ্র ভারতে এবং পাকিস্তানের অংশ বিশেষে ১৯৫৭ সালে সিপাই বিদ্রোহ শতবার্ষিকী পালন করা হয়েছিল, ঘটনাবহুল সভা-সমিতি ও উৎসবানুষ্ঠানের মাধ্যমে। তখন বহু ঐতিহাসিক সিপাই যুদ্ধের বিভিন্ন দিকের উপর আলোকপাত করে জনপ্রিয় ও গবেষণাধর্মী প্রবন্ধ ও বইপত্র লিখেছিলেন শতবার্ষিকীর বৎসরটিকে উজ্জ্বলভাবে চিহ্নিত করার উদ্দেশ্যে। তাঁদের মধ্যে অনেকের ধারণা ছিল, সিপাই যুদ্ধ ছিল ভারতবাসীদের জন্য একটি ব্যাপক স্বাধীনতা সংগ্রাম অথবা একটি সুসংহত জাতীয় আন্দোলন। অন্য এক দল ঐতিহাসিকের মতে এই বিদ্রোহ মূলতঃ একটি সামরিক অভ্যুত্থান, নতুন রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক ব্যবস্থার আওতায় এসে যাদের স্বার্থ ক্ষুণ্ণ হয়েছিল, সেই অপরিতৃপ্ত রাজা, মহারাজা ও জমিদারশ্রেণী এই আন্দোলনের সুযোগ নিয়ে নিজেদের ব্যক্তিগত স্বার্থ অথবা শ্ৰেণীস্বার্থ হাসিল করতে চেয়েছিলেন। পরস্পর বিরোধী এইসব মতামতের যথার্থ বিচার না করেও বলতে চাই, তখন আমার মনে হয়েছিল এবং এখনো মনে হয়) উপরোক্ত দু’ধরনের অভিমতের মধ্যে জাতীয়তাবাদী মানসিকতা প্রশ্রয় পেয়েছিল; নইলে উপমহাদেশের খ্যাতনামা ঐতিহাসিকগণ বিশেষ প্রয়োজনের তাগিদে এবং বিশেষ রাজনৈতিক পরিবেশে সিপাই যুদ্ধ সম্বন্ধে মতামত প্রকাশের জন্য অতটা আগ্রহ কেন দেখিয়েছিলেন? ইংরেজ শাসন অবসানের মাত্র দশ বছর পর ঐতিহাসিকদের তরফ থেকে ঐ ধরনের প্রতিক্রিয়া হয়ত বা স্বাভাবিক ছিল, কিন্তু অত্যন্ত আশ্চর্য হয়ে লক্ষ্য করেছিলাম যে, তখনকার দিনের পূর্ব-পাকিস্তানের সিপাই বিদ্রোহের উপর কোনো উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ অথবা প্রবন্ধ লেখা হয়নি। আজো এ-কথা ভেবে অবাক হতে হয় যে, যে দেশে মাতৃভাষার জন্য রক্তপাত হয় এবং সুদীর্ঘ ২৭ বছর ধরে ২১শে ফেব্রুয়ারি শোকদিবস হিসেবে গতানুগতিকভাবে উদযাপিত হয়, সেই দেশে ঐতিহাসিক ও দার্শনিক বিষয়বস্তু অবলম্বনে বাংলা ভাষায় কোনো উল্লেখযোগ্য গবেষণা গ্রন্থ অথবা জনপ্রিয় গ্রন্থ লেখা হয়নি। আমাদের দেশের লেখক ও গবেষকদের সাম্প্রতিক এই বন্ধ্যাত্বসূচক মানসিকতা ১৯৫২ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারির রক্তপাতের চেয়েও বেশি শোকাবহ। কেননা সেই রক্তের মধ্যে সৃষ্টিশীলতার অফুরন্ত সম্ভাবনা ছিল; আর লেখক ও গবেষকদের সাম্প্রতিক মানসিক পঙ্গুতা প্রমাণ করছে যে, সেই সম্ভাবনা প্রায় তিন যুগের মধ্যেও বাস্তবে পরিণতি পায়নি। ইতিহাস ও দর্শনের ব্যাপক অনুশীলন ছাড়া কোন ব্যক্তি বা সমাজ মানসিক পরিশীলন অর্জন করতে পারে না- সভ্যজীব হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেতে পারে না। সেই জন্য ইতিহাস বা দর্শনের বিশেষ অংশের উপর বাংলায় লেখা যে কোন চলনসই গবেষণাগ্রন্থ অথবা জনপ্রিয় পুস্তকের আবির্ভাব নিঃসন্দেহে অভিনন্দনযোগ্য।
সিপাই বিদ্রোহের গুরুত্ব আধুনিককালের ইতিহাসে অপরিসীম। শাসিত ও শাসক উভয়েই এই ঘটনা থেকে বিশেষভাবে শিক্ষা নিয়েছিল। বিদ্রোহের চুড়ান্ত পর্যায়ে ভারতের ইংরেজ শাসনের মেরুদণ্ড প্রায় নুয়ে পড়েছিল। সেইজন্য বিদ্রোহ দমনের জন্য ব্যাপক প্রশাসনিক পরিবর্তনের প্রয়োজন অনুভূত হয়েছিল এবং এই পরিবর্তিত ব্যবস্থার মাধ্যমে প্রায় অর্ধশতাব্দী ধরে ভারতে ইংরেজ শাসনের যে অধ্যায় রচিত হল তা বিভিন্ন কারণে বিশিষ্ট; তা ইংরেজ রাজত্বের ইতিহাসে সবচেয়ে গৌরবময় অধ্যায়। বিদ্রোহের শেষে শাসিতদের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ বুঝতে পারল যে ইংরেজ শাসন টিকে গেছে; অতএব শিক্ষা ও সংস্কৃতির ক্ষেত্রে পশ্চিমের ধ্যান-ধারণাকে স্বাগত না জানিয়ে আর উপায় নেই। উনিশ শতকের শেষার্ধে তাই ভারতের সাংস্কৃতিক ও সামাজিক ইতিহাসের এক গুরুত্বপূর্ণ ক্রান্তিকাল।
সিপাই বিদ্রোহ জাতীয় ঘটনার উপর লেখা ইংরেজি গ্রন্থ অসংখ্য, কিন্তু বাংলা লেখা বই প্রায় নেই বললেই চলে। আমাদের দেশের সাংস্কৃতিক শূন্যতার ক্ষেত্রে যেখানে বাংলায় ইতিহাসচর্চা অত্যন্ত নিরুৎসাহজনক পর্যায়ে বিষয়বস্তুর গুরুত্বের জন্যও আহমদ ছফার এই রচনাটির গুরুত্ব অনস্বীকার্য। আহমদ ছফা সৃজনশীল লেখক, কবি ও সাহিত্যিক হিসেবে বহুদিন আগেই প্রতিষ্ঠা পেয়েছেন। ইতিহাস ও সমাজতত্ত্বের উপর লেখা তাঁর কয়েকটি প্রবন্ধ ইতিমধ্যে প্রকাশিত হয়েছে। তবে ব্যাপক ইতিহাস আলোচনার ভিত্তিতে রচিত গ্রন্থ হিসেবে ‘সিপাহী যুদ্ধের ইতিহাসই তাঁর প্রথম রচনা। এ-গ্রন্থে প্রকাশ পেয়েছে ঘটনার ধারাবাহিকতা চিহ্নিতকরণের প্রয়াস এবং সর্বোপরি লেখকের অনুসন্ধিৎসু মন। তাঁর ভাষার সাবলীল গতি লক্ষ্য করলেই বুঝতে পারা যায়, এ-ভাষা এসেছে কোনো সৃষ্টিশীল শিল্পীর লেখনী থেকে। লেখক নিষ্ঠার সঙ্গে বহু প্রামাণ্য গ্রন্থ পড়ে রচনাটির জন্য তথ্য সংগ্রহ করেছেন।