১৮৫৭ সালের ২২শে জানুয়ারি লেফটেনান্ট রাইট বিষয়টি দমদম আগ্নেয়াস্ত্র বিভাগের কম্যাণ্ডিং অফিসার মেজর বন্টেনের দৃষ্টিগোচর করলেন। মেজর বন্টেন তাঁর ঊর্ধ্বতন অফিসারের কাছে লিখলেন, “গতকাল সমস্ত দেশীয় সেপাইদেরকে প্যারেড করবার সময়, কোন অভিযোগ থাকলে জানাতে বলেছিলাম। কমপক্ষে তিনভাগের দু’ভাগ সৈন্য সামনে এসে দাঁড়ালো। তার মধ্যে কমিশন প্রাপ্ত সমস্ত দেশীয় অফিসারেরাও ছিলো। অত্যন্ত ভদ্রোচিতভাবে তারা জানালো যে বর্তমান কার্তুজ তৈয়ারীর পদ্ধতির বিরুদ্ধে তাদের আপত্তি আছে। তারা অত্যন্ত স্পষ্টভাবে অভিযোগ করেছে যে কার্তুজে যে চর্বি মেশানো হয়, তা তাদের ধর্ম-বিশ্বাসের সম্পূর্ণ পরিপন্থী। এর বিকল্প স্বরূপ সেপাইরা নোম এবং তেলের ব্যবহার করে কাজ চালাবার পরামর্শ দান করেছে।” এটা পরিষ্কার সেপাইদের মনে প্রথম প্রতিক্রিয়া হয়, তার মূলে ছিলো ভয়, কোন প্রকারের ক্রোধ নয়। তারা অত্যন্ত শ্রদ্ধার সঙ্গে বন্টেনের কাছে কেননা টোটা ব্যবহার করতে পারবে না তার সঙ্গত কারণ নির্দেশ করেছে। তার বিকল্প ব্যবস্থাও দেখিয়ে দিয়েছে। প্রচারিত খবরে সেপাইদের সন্দেহ করার যথার্থ কারণ ছিলো যে কার্তুজের সঙ্গে অবশ্যই আপত্তিজনক কিছু মাখানো রয়েছে। কীথ ইয়ং-এর কাছে এক পত্রে প্রদান সেনাপতি স্বয়ং লিখেছেন, “কার্তুজের সঙ্গে মেশানো স্নেহ পদার্থের (চবি) পরিমাণ দেখে সেপাইরা যে আপত্তি করেছে, তাতে অবাক হওয়ার কিছু নেই।” মার্চ মাসের ২৩ তারিখে এ পত্র লেখা হয়েছিলো। কিন্তু পয়লাদিকে সেপাইদের মনে যে কোনো সন্দেহের উদয় হয়নি, সে সম্বন্ধে একরকম নিশ্চিত করেই বলা যায়। ফোর্ট উইলিয়ামের অস্ত্র বিভাগের ইন্সপেক্টর জেনারেল কোনো প্রমাণ দেখাতে পারলেন না যে চর্বি আপত্তিজনকভাবে সংগৃহীত হয়নি। ২৯শে জানুয়ারি তিনি লিখেছেন যখন আমি শুনতে পেলাম, সামরিক ডিপোর দেশীয় সেপাইরা দমদমে চর্বি ব্যবহারে আপত্তি করেছে, আমি তখনই পরীক্ষা করে দেখলাম যে লন্ডনের ডিরেকটর সভা যেভাবে তৈরি করতে নির্দেশ দান করেছেন, সেভাবেই তা তৈরি করা হয়েছে। তাতে চর্বি এবং মৌমাছির মোম মেশানো হয়েছিলো। আপত্তিজনক চর্বি ব্যবহার না হতে পারে তার জন্য পূর্ব থেকে সতর্কতামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়নি। এখানে অবশ্য স্বীকার করা হয়নি যে কোনো গরুর চর্বি মেশানো হয়েছে। তেমনি এ মসৃণকারী পদার্থ কিভাবে তৈরি করা হচ্ছে সে সম্বন্ধে ব্রাহ্মণ সন্তানদেরও কোনো ধারণা ছিলো না। চর্বি এবং মোম সরবরাহ করতো একজন বাঙালি ব্রাহ্মণ ঠিকাদার। তার লোকজন হয়তো বাজার থেকে সস্তা চর্বি কিনেও সরবরাহ করতে পারে। তখন ইংরেজরা ধরে নিয়েছিলো ঠিকাদার খারাপ চর্বি সরবরাহ করেছে, কারণ তাকে অন্য চর্বি ব্যবহার করতে নিষেধ করা হয়নি। ২৩শে ফেব্রুয়ারী ‘টাইম পত্রিকার সংবাদদাতা লিখেছেন, “নতুন এনফিল্ড রাইফেলের কার্তুজে চর্বি মাখানো হয়, যাতে করে সহজে নলের মধ্যে প্রবিষ্ট হয়। সরকার ঠিকাদারকে ছাগলের চর্বির জন্য নির্দেশ দিয়েছিলেন, সামান্য পয়সা বাঁচাবার জন্য ঠিকাদার গরু অথবা শুয়রের চর্বি সরবরাহ করেছে।” কতিপয় সেপাই কলকাতা দুর্গের অধ্যক্ষকে অনুরোধ করেছিলেন একজন উচ্চ বর্ণের হিন্দু এবং একজন মুসলমানকে চর্বি মাখানোর কারখানায় নিয়োগ করলে সমস্ত সন্দেহের অবসান হয়। অধ্যক্ষের নিয়োগে কোনো আপত্তি ছিলো না, কারণ তার ফলে সেপাইদের মনের সন্দেহের নিরসন হবে। কিন্তু অস্ত্র বিভাগ তা অনুমোদন করলো না। স্বভাবতই সেপাইরা ভাবতে লাগলো যে কর্তৃপক্ষের নিশ্চয়ই কোনো খুঁত আছে, নয়তো দুর্গের অধ্যক্ষের এমন ভালো পরামর্শ তারা গ্রহণ করলো না কেনো?
চর্বি মাখানো টোটার ব্যবহারের পেছনে সত্যিকারের কোনো ভালো মনোভাব ছিলো না। ১৮৫৩ সালে এ কার্তুজ ব্যবহারের জন্য নয়, আবহাওয়ায় উপযুক্ত কিনা পরীক্ষা করে দেখবার জন্য ভারতে আমদানী করা হয়। ভারতীয়দের দিয়ে পরীক্ষা করালে বিরূপ প্রতিক্রিয়া হবে এ সম্বন্ধে কর্ণেল টুকার সামরিক বোর্ডকে হুঁশিয়ারী করেছিলেন। তিনি শুধুমাত্র ইউরোপীয় সৈন্যদের মধ্যেই টোটা বিতরণ করতে পরামর্শ দিয়েছিলেন সে সময়ে। তাঁর সতর্কবাণীর কোনোই আমল দেয়া হয়নি পরবর্তীকালে। ভারতীয় সেপাইদেরকেও থলিতে করে টোটা বইতে দেয়া হয়। সে যাকগে, কিসের চর্বি সে সম্বন্ধে একবারও সেপাইদের মনে সন্দেহের উদ্রেক হয়নি, দুর্যোগের পূর্ব পর্যন্ত। ১৮৫৭ সালে সেপাইরা ন্যায্য কারণে আপত্তি তুললো। যদি তারা টোটা কামড়ে বন্দুকে পূরে তাহলে তাদের ভীষণ সামাজিক অসুবিধার সম্মুখীন হতে হয়। সরকার টোটার ব্যবহার বন্ধ অথবা সেপাইদেরকে আপনাপন চর্বি তৈরি করতে দেবে কিনা এবং এ সম্বন্ধে তাদের ভয়ের কোনো কারণ আছে কিনা তা পরীক্ষা করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলেন। কিন্তু দমদমে যে টোটা বিলি করা হয়েছিলো, তাতে সন্দেহ নেই। কোনো নিষিদ্ধ চর্বি ব্যবহার করা হচ্ছে কিনা সে সম্বন্ধে কোনো সর্তকতামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করার জন্য অস্ত্র বিভাগ গুরুতরভাবে অপরাধী।
সরকার ত্বরিত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলেন। ব্যারাকপুরের সৈন্যাধ্যক্ষ জেনারেল হীয়ার্সে সেপাইদেরকে তাদের পছন্দ অনুসারে চর্বি তৈরি করতে অনুমতি দিলেন। ২৮শে জানুয়ারি তারিখে সরকার তাঁর পরামর্শে অনুমোদন দান করলেন। লেফটেনান্ট রাইটের রিপোর্ট এবং কলকাতা থেকে সরকারের উত্তর পৌঁছাবার সময়ের মধ্যে সেপাইদের বিক্ষোভ তীব্র হতে তীব্রতর হয়ে উঠতে লাগলো। গুজব ছড়িয়ে পড়লো, সরকার ইচ্ছে করেই তাদের জাতি এবং ধর্মনাশ করার জন্য চর্বি মাখানো টোটার প্রবর্তন করেছে। তাদের খ্রীস্টান না বানিয়ে সরকার ছাড়বে না। ইতিমধ্যে এ্যাডজুট্যান্ট জেনারেলের ওপরে পরিদর্শনের দায়িত্ব দেয়া হলো, যাতে করে মীরাট, আমবালা এবং শিয়ালকোটে কোনো চর্বি মাখানো টোটা না বিতরণ করা হয় এবং সেপাইরা আপন আপন ইচ্ছা মতো মসৃণকারী পদার্থ ব্যবহার করতে পারে। তিনি বলেছেন, কিছুদিন আগে থেকে মিনি রাইফেলধারী সেপাইরা নির্দোষ চর্বি মাখানো টোটা ব্যবহার করে আসছে। তার ফলে অবচেতন মনে তারা ভাবতে পারে যে সরকার ইচ্ছে করেই তাদের দিয়ে আপত্তিজনক চর্বি ব্যবহার করিয়ে তাদের ধর্মনাশের ব্যবস্থা করেছে। তখন আর কিছুই করা হয়নি এবং সেপাইদের সন্দেহ ক্রমবর্ধমান হারে ঘনীভূত হতে থাকে। এ ছিলো মারাত্মক প্রমাদ। মীরাটের সেপাইরা জানতেও পেলো না যে তারা নিদোষ কার্তুজ ব্যবহার করছে।