শুধুমাত্র রাজপুরুষদের বাদ দেয়া হয়েছে। তাদেরও ধ্বংস এবং রাজ্যহীন করার ভয় দেখানো হয়েছে। ১৮৪৯ সালে ইংরেজরা পাঞ্জাব দখল করে নিলো। পাঞ্জাবের রাজা ছিলেন কোম্পানীর অধীনস্থ মিত্র। মুলতান অভ্যুত্থান, যার ফলে দ্বিতীয় শিখ যুদ্ধের সূত্রপাত, তার সঙ্গে পাঞ্জাবের রাজার কোনো সম্বন্ধ ছিলো না। আসল ওয়ারিশের অভাবে সাতারা, ঝাসী, তাঞ্জোর ইত্যাদি ছোট ছোট রাজ্যগুলো কোম্পানী গ্রাস করে নিলো। পেশবার রাজ্যকে সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত করার সময় মারাঠাদের আত্মাভিমান অক্ষুণ্ণ রাখার জন্য সাতারায় সর্দার প্রথার প্রবর্তন হয়। এই ক্ষুদ্র রাজ্যটিতে পুরোনো অভিজাত বংশের উত্তরাধিকারীরা তখনো সামরিক এবং শাসন বিভাগীয় উচ্চপদে আসীন হওয়ার আশা পোষণ করতেন। ঝাসীর শাসকেরা কোম্পানীর অনুগ্রহে একবার ওয়ারিশ নির্বাচন করেছেন। পুত্রহীন অবস্থায় এক ভাই মারা গেলে আরেক ভাইকে উত্তরাধিকারী করা হয় একবারের বেশি। অনেক দিন ধরে তাঞ্জোর ছিলো কোম্পানীর অধীন মিত্র। রাজবংশ ছিলো মারাঠা। কিন্তু এসব মারাঠা রাষ্ট্র নয় শুধু, বৈধ পুত্র সন্তানহীন অবস্থায় নাগপুরের শেষ রাজা মৃত্যুমুখে পতিত হলে তাঁর রাজ্য কোম্পানীর সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যায়। শেষ পর্যন্ত রাজবাড়ির মহিলাদের আপত্তি সত্ত্বেও এভাবে রাজ্যগ্রাস করার নীতি এবং পদ্ধতি জনগণের মধ্যে অপরিসীম অসন্তোষের সৃষ্টি করে। ভোঁসলার অস্থাবর এবং স্থাবর সম্পত্তি নিয়ে যাওয়া হয়। দুটো রাজকীয় হস্তী, অনেকগুলো ঘোড়া এবং বলদ সিতাবলদীতে পশু ব্যবসায়ীদের কাছে বিক্রি করে দেয়। রাজবাড়ির আসবাবপত্র সরাতে চাইলে বিদূষী মহিলা রাণী বঙ্ক বাঈ রাজবাড়িতে আগুন লাগিয়ে দেবার ভয় দেখায়। কিন্তু আসবাবপত্র তারা নিয়ে গেলেই গেলো। ভেসলা পরিবারের অলঙ্কার এবং মণি মাণিক্য কলকাতার বাজারে প্রেরণ করা হলো। রাজ্য দখল করার চাইতে স্থাবর অস্থাবর জিনিসপত্র ও অলঙ্কার নিয়ে যাওয়ার প্রতিক্রিয়া খুবই খারাপ হয়েছিলো।
সম্বলপুরের সর্দারের ক্ষুদ্র রাজ্যকে একসময়ে নাগপুরের অধীনে করা হয়েছিলো, পরে সাম্রাজের অন্তর্ভুক্ত করে নিলো। মুর্শিদাবাদের নওয়াবদের মতো কর্ণাটকের নবাবেরাও বহুকাল আগেই রাজ্যশাসন করা ছেড়ে দিয়েছিলেন। ১৮৫৪ সালে নওয়াব খ্যাতিরও অবসান হলো। পরবর্তী বছরে হিন্দুরাজ্য তাঞ্জোরও গেলো। রাজপুত রাজ্য কারৌলীর উপর কোনো জোর প্রয়োগ করা হয়নি। সাতারা এবং ঝাঁসীর মতো যে সকল রাজ্য ব্রিটিশের সৃষ্ট নয় সেগুলো যতোই ক্ষুদ্র হোক না কেনো, গ্রাস করার ব্যাপারে বিচার বিবেচনা করতে পারতেন। বড়লাট ডালহৌসী। আইনের কোনো সুবিধা পেলেই ব্রিটিশ শাসনের কল্যাণে হস্ত প্রসারের ব্যাপারে কোনো রকম বিলম্ব করতেন না। এ জাতীয় সমস্যা দেখা দিলে তার সহকর্মীদের পরামর্শ নেয়ার প্রয়োজনও অনুভব করতেন না। তার উদ্দেশ্যের মধ্যে গলদ আবিষ্কার করা অসম্ভব। রাজ্যসমূহের অন্তর্ভূক্তির ফলেই ভারত সংযুক্ত করতে পেরেছে, যাকে ভারতীয় জাতীয়তার ভিত্তি বলা যেতে পারে। কিন্তু ডালহৌসীর তেমন কোনো আকাক্ষা ছিলো না। ডালহৌসীর নির্জলা সাম্রাজ্যবাদী নীতি কোনো উপকার করেনি। ঝাঁসীর রাণী এ অন্তর্ভুক্তিকে মেনে না নিয়ে সুপ্রীম কোর্টে প্রতিনিধি পাঠালেন। সাঁতারা রাজ্যের পক্ষে ওকালতী করার জন্য রঙ্গ বাপুজী লন্ডন যাত্রা করলেন। সম্বলপুরের রাজবংশীয়েরা যুদ্ধ ঘোষণা করলেন। কর্ণাটক এবং তাঞ্জোরের এহেন পরিণতিতে ভারতীয় জনমত বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গেলো। কারণ, ও দু’টো রাজ্য সব সময় অনুগত ছিলো এবং দীর্ঘদিন যাবৎ কোম্পানীর সরকারের সঙ্গে ভালো সম্পর্ক রক্ষা করে আসছে। তারপরেও ব্রিটিশের সুবিচার সম্পর্কে যতোটুকু শ্রদ্ধা ছিলো ১৮৫৬ সালে অযোধ্যা গ্রাস করার পর তার তিলমাত্র অবশিষ্ট রইলো না।
সীতারামের মতে, তালুকদার এবং সর্দারেরা মতামত পোষণ করলো, সরকার নওয়াবকে অসম্মান করেছেন, তাঁর প্রতি অবিচার করেছেন। হেদায়েত আলী আরো পরিষ্কার ভাষায় বলেছেন, “অযোধ্যার অন্তর্ভূক্তির সময় হিন্দুস্থানের সকলেই বলাবলি করছিলো ব্রিটিশ সরকার অযোধ্যার নওয়াবের সঙ্গে প্রতিজ্ঞা করেছিলেন যে (আমার বিশ্বাস, এরকম একটা সন্ধিপত্র ছিলো) তারা কখনো নওয়াবের রাজ্যদান করেছেন। হিন্দুস্থানের সকলে বলাবলি করতে লাগলো রাজা নওয়াবের, তিনি নিজের সরকারের ব্যাপারে যাই করে থাকুন না কেনো, কোনোক্রমেই ইংরেজদের সঙ্গে বিশ্বাস ভঙ্গ করেননি। এতে অনুগত এতো বিশ্বস্ত নওয়াবের যখন এ অবস্থা, স্বাধীন রাজা এবং নওয়াবদের অবস্থা কি হবে?
অযোধ্যা দখলের সংবাদে ইংরেজ ভদ্রলোক এবং ভদ্রমহিলারাও উৎকণ্ঠিত হয়ে উঠেছিলো। এ দুঃখজনক ঘটনা তাঁদের বিচলিত করে তুলেছিলো। এটাকে তারা অন্যায় কাজ বলেছেন। মিসেস হ্যারিস লিখেছেন সে সম্বন্ধে, “আজকে ডিনার পার্টিতে অযোধ্যায় অন্যায়ভাবে অন্তর্ভুক্তির কথা আলোচনা হচ্ছিলো, আমরা শাসিতদের প্রতি যে অবিচার করছি তাতে করে জাতীয় মর্যাদাকেই অবনমিত করছি। আমাদের নওয়াবের আপন লালসা এবং লোভের শেষ বলী হতে হলো অযোধ্যাকে।”
বাঙ্গালী পল্টনে উচ্চবর্ণের ব্রাহ্মণ এবং রাজপুতদের ভর্তি করানোই বিদ্রোহের কারণ বলা হয়। কর্ণেল হান্টার সে কথা অস্বীকার করেছেন। সাঁওতাল এবং ভীলদের কোন গোত্র নেই, কোনো কোনো অঞ্চলে তারা বিদ্রোহী সেপাইদের সহায়তা করেছে। নিম্নশ্রেণীর যোগানদার সৈন্যরা মীরাটে সশস্ত্র বিদ্রোহ করেছে। উচ্চ শ্রেণীর ব্রাহ্মণ যেমন, তেমনি নিম্নশ্রেণীর পাচিরাও ধর্মযুদ্ধে অংশ গ্রহণ করেছে। সুপরিকল্পিত অথচ সুচিন্তিত নয়, এমন কতেক আইন এবং শাসন পদ্ধতি প্রবর্তনের ফলে সেপাইদের মনে অবিশ্বাস এবং সন্দেহ দানা বাঁধতে থাকে। তার ফলে সরকারের প্রতি সেপাইরা সম্পূর্ণ বিশ্বাস হারিয়ে ফেলে। তা ছাড়া পরবর্তী গভর্ণর জেনারেলদের অপ্রিয় শাসনের ফলে জনগণ বিশ্বাস হারাতে থাকে। লর্ড ডালহৌসীকে সাধারণভাবে অভ্যুত্থানের জন্য দায়ী করা হয়। কিন্তু অন্য কোন কারণ না থাকলে তার কোনো কাজের ফলে অভ্যুত্থান হতে পারতো না। এ জন্য লর্ড আমহার্স্ট, লর্ড উইলিয়াম বেন্টিঙ্ক, লর্ড অকল্যান্ড, লর্ড এলেনবরো সকলেরই নিজের নিজের অবদান রয়েছে। বিদেশী সরকার জনগণের আনুগত্যের ওপর নয়, সামরিক শক্তির ওপরই প্রতিষ্ঠিত ছিলো। সেপাইরা উপলব্ধি করতে পারলো, এতোকাল তারাই তো বজ্রবাহু দিয়ে এ সাম্রাজ্য রক্ষা করেছে, এখন ইচ্ছে করলে ভেঙ্গে ফেলতে পারে। তবু তারা নিমকহারামী করেনি। কিন্তু যখন দেখতে পেলো যে পিতৃপুরুষের ধর্মের উপর আঘাত আসছে সে আনুগত্যের ভিত্তিমূল বিদীর্ণ হয়ে গেলো। শিক্ষিত সম্প্রদায় জনগণের সঙ্গে সংযোগ করে হয়তো এ অভ্যুত্থান ঠেকাতে পারতেন, সরকার তাঁদের সে সুযোগ দেননি। বিদ্রোহের কারণগুলো অনেকদিন ধরে সঞ্চিত হয়েছিলো-চর্বি মাখানো টোটা বেগকে ত্বরান্বিত করেছিলো মাত্র।
২. ঘটনা পরম্পরা
সেনাবাহিনীকে আধুনিক অস্ত্রশস্ত্রে সুসজ্জিত করতে হবে। উনবিংশ শতাব্দীর মধ্যকাল যাবত ব্রাউন বেস নামক আগ্নেয়াস্ত্রই ছিলো সেপাইদের কাছে অত্যন্ত প্রিয়। ১৮৫২ সালে মাষ্টার জেনারেল অব দ্যা অর্ডন্যান্স ভাইকাউন্ট হার্ডিঞ্জ-এর আদেশানুক্রমে এনফিল্ড অস্ত্র উন্নয়নের পরীক্ষা করা হয় এবং নতুন পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে এক ধরনের রাইফেলের উদ্ভাবন করা হয়। ১৮৫৩ সালের ক্রিমিয়ার যুদ্ধে নতুন রাইফেল পরীক্ষা করে বেশ সুফল পাওয়া যায় এবং ১৮৫৬ সালে ভারতে এ রাইফেল চালু করা হয়। রাইফেলের সঙ্গে লন্ডন থেকে এলো চর্বি মাখানো টোটা। পরে ভারতীয় সেপাইদের ব্যবহারের জন্য কলকাতা দমদম এবং মীরাটে এ টোটা তৈরি হতে থাকে। এ উন্নত ধরনের অস্ত্রের ব্যবহার শিক্ষা করার জন্য নির্বাচিত সেপাইদের দমদম, আমবালা এবং শিয়ালকোটের ট্রেনিং কেন্দ্রে প্রেরণ করা হয়। একজন উচ্চ শ্রেণীর ব্রাহ্মণ একজন নীচ শ্রেণীর লস্করের কাছে জানতে পারলো যে। টোটার সঙ্গে মাখানো রয়েছে আপত্তিজনক পশুর চর্বি। এ খবর জানার পূর্বে পর্যন্ত কোনো দুর্ঘটনা ঘটেনি। দাবানলের মতো খবর ছড়িয়ে পড়লো। সেপাইদের মধ্যে অসন্তোষ এবং বিক্ষোভের সঞ্চার হতে থাকে। কলকাতা ধর্মসভা এ খবর প্রচার করে ইংরেজ অফিসারকে সতর্ক করে দিলো। তারাও এ সম্বন্ধে ভালোভাবে ওয়াকেবহাল হলেন।