উপযুক্ত দেশীয়দেরকে সরকারি চাকুরি থেকে ধারাবাহিকভাবে বহিষ্কার করার কারণে ভারতীয়দের অসন্তোষ আরো ব্যাপক আকার ধারণ করে। ভারতীয়রা শাসন বিভাগে ডেপুটি কালেক্টর এবং বিচার বিভাগে সদর আমীনের চাইতে কোনো উচ্চতরো চাকুরিতে নিয়োজিত হতে পারতো না। কিন্তু ভারতীয়দের মধ্যে কোনো প্রতিভার অভাব ছিলো না। তাদের পিতা পিতামহরা যে এদেশ শাসন করেছে, সেনাবাহিনী পরিচালনা করেছে, সে স্মৃতি এখনো তাদের মনে জীবন্ত। আইনের চোখে সকলকে সমান করে দেয়ার কারণে, ভারতের অভিজাত সমাজের অভিযোগ ফেনিয়ে উঠলো। ব্রিটিশ আইন ধনী-নির্ধন, উঁচু-নীচ, রাজা এবং প্রজার মধ্যে কোনো ভেদাভেদ রাখেনি। লখনৌর ওয়ালী বিরজিস কাদের তাঁর এক ফরমানে বলেছেন, হিন্দু মুসলমান সকলের কাছেই চারটি জিনিস পরম মূল্যবান। প্রথম হলো ধর্ম, দ্বিতীয় হলো সম্মান, তৃতীয় জীবন, চতুর্থ সম্পদ। দেশীয় শাসকদের অধীনে এ চারটি জিনিস সব সময় নিরাপদ। তিনি আরো বলেছেন, আগের শাসনামলে অভিজাত মুসলমান এবং উচ্চ বর্ণের হিন্দুদের সম্মান রক্ষা করা হতো। কিন্তু ইংরেজরা উল্লেখিত চারিটি জিনিসের শত্রু হয়ে দাঁড়িয়েছে। উচ্চ এবং নীচের সম্মান এবং মর্যাদা তাদের আইনে এক করে ফেলা হয়েছে। নীচ সম্প্রদায়ের তুলনায় উচ্চবর্ণ এবং অভিজাতদের সঙ্গে তারা আরো খারাপ ব্যবহার করে। এ অভিযোগ ভিত্তিহীন নয়। কিন্তু তাতে ইংরেজদের কৃতিত্বই প্রমাণিত হয়। তারা জাতি, ধর্ম, বর্ণ, ধনী-দরিদ্র নির্বিশেষে সকলের জন্য ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার কারণেই তা করেছিলেন। সে যাহোক, অনেক ইংরেজ ভদ্রলোক এবং অধিকাংশ ভারতীয় এর বিরোধিতা করেছিলেন। লখনৌ ঘোষণার মধ্যেও একই মনোভাবের প্রকাশ দেখা যায়। রাজা এবং নওয়াবদের যে ইংরেজরা হাজির হতে বাধ্য করে তাদের সঙ্গে চামারের তুলনা করা হয়েছে। আইন লোকের সম্মানের রক্ষক রইলো না। আর, এতোকাল যে সকল লোক আইনের উর্ধ্বে ছিলেন, তাঁদেরকে আইনের আওতায় আসতে বাধ্য করার ফলে তাঁদের মধ্যে অসন্তোষের সীমা রইলো না। তাছাড়া এ আইন জনগণের কাছেও প্রিয় ছিলো না। তার কারণ এ নয় যে, আইন নিষ্ক্রিয় ছিলো, বিচারালয়গুলোর দুর্নীতিই আইনের অপ্রিয় হওয়ার কারণ। তা ছাড়া এদেশের অশিক্ষিত জনগণ ইংরেজদের আইনের অতো ঘোরপ্যাঁচ বুঝতে পারে না। তাদের বক্তব্য পেশ করার জন্য একজন উকিল নিয়োগ করা তাদের অনেকের পক্ষেই সম্ভব ছিলো না। আগেকার প্রথা অনুসারে ধনী-দরিদ্র সকলেরই অবাধে বিচারালয়ে প্রবেশ করতে কোনো বাধা ছিলো না। সকলেই খোলাখুলি আপনাপন অভিযোগ ব্যক্ত করতে পারতো। একজন দরিদ্র কৃষককেও কোনো বাধার সম্মুখীন হতে হতো না। ডেপুটি কমিশনারের বিচারালয়কে খোলা বিচারসভা বলে শোনার পর একবার সীতারাম চাপরাশীর নির্দেশ অমান্য করে বিচার কক্ষে প্রবেশ করেছিলেন এবং সে জন্য দশ টাকা অর্থদণ্ড হয়েছিলো। সীতারাম কিভাবে যে আইন লঙ্ঘন করেছিলেন, এ কথা কোনোদিন বুঝতে পারেননি; পুলিশ এবং ছোটখাট কর্মচারীদের দুর্নীতির কুখ্যাতি এবং মন্দ আচরণের জন্য বিচারালয়গুলো আরো অপ্রিয় হয়ে পড়লো। দেশের মানুষ বিশ্বাস করতে লাগলো অধীনস্থ কর্মচারীরা যে টাকা উৎকোচ গ্রহণ করে তার একাংশ বড়ো সাহেবের কাছেও যায়। সুতরাং বিচারালয় ধনীদের হাতের একটি অস্ত্র হয়ে দাঁড়ালো, বিচারালয়ের মাধ্যমে অত্যাচার করা হতে লাগলো। মিথ্যা সাক্ষ্য দেবার মানুষ কিনতে পাওয়া যেতো এবং মিথ্যা দাবি হাজির করা হতো। জমি বিক্রয়ের আইনটা ছিলো সবচেয়ে অপ্রিয়। প্রাচীন প্রথা অনুসারে জমি বেহাত হতো না। একজন মালিক যদি বকেয়া খাজনা শোধ না করতে পারতো তা হলে, আত্মীয় স্বজনেরা মুক্ত করে না নিয়ে যাওয়া পর্যন্ত তাদেরকে আটক করে রাখা হতো। তাছাড়া ফসলের মাধ্যমে খাজনা পরিশোধ করতে হতো। তাও পর্যায়ক্রমে বিভিন্ন ফসলের সময়ে আদায় করা হতো। এ পদ্ধতিটা সেকেলে এবং সংস্কার সাপেক্ষ ছিলো তাতে সন্দেহ নেই। কোম্পানীর সরকার বকেয়াদারদের জমি দখল করে নেয়ার কার্যকরী, সরল এবং দ্রুত পদ্ধতির প্রবর্তন করলেন। থিয়োরীগতভাবে দেখতে গেলে এ পদ্ধতির কোনো দোষ পাওয়া যাবে না। যদি সে খাজনা শোধ করতে না পারে তা হলে স্বত্ব হারাবে। কিন্তু জমির প্রতি তাদের ছিলো অন্তহীন মমতা। খাজনা ছাড়াও জমির মাধ্যমে একটা সম্প্রদায় গড়ে উঠেছিলো। যারা কেউ হয়তো তাদের আত্মীয় নয়, একই গ্রামবাসী কৃষক হয়তো সকলে। জমি হারালে শুধু অর্থনৈতিক ক্ষতি হতো না, সামাজিক মর্যাদাও চলে যেতো।
খাজনার পরিমাণ পরিমিত হলে জমি বিক্রয়ের আইন প্রজা সাধারণের তেমন ক্ষতি করতো না। সরকার খাজনা নিরূপণের স্পষ্ট আইন করে দিয়েছেন। কড়াকড়ি ভাবে আইনানুসারে সবকিছু করা হলে কখনো অঘটন ঘটতো না। মথুরার কালেক্টর মিঃ থর্ণহিল এ সম্বন্ধে বলেছেন, সরকারি আইনের প্রতি নিয়মিত আনুগত্য পোষণ করা হলে, কর্মচারীদের পদোন্নতি হয় না। খাজনা নির্ধারণের জন্য জমি জরীপের ভার ছিলো তরুণ কর্মচারীদের ওপর-যদের চাকুরি জীবনের সম্পূর্ণ ভবিষ্যৎ এর ওপর নির্ভর করছিলো। তারা এমন বেশি খাজনা ধার্য করলো যা জমিদারদের পক্ষে দীর্ঘদিন নিয়মিতভাবে শোধ করা অসম্ভব ছিলো। ভাল ফসলের সময় অল্পস্বল্প খাজনার দাবি মেটালেও অজন্মর বছরে তারা দাবি মেটাতে গিয়ে একেবারে ধ্বংস হয়ে গেলো। উইলিয়াম এডওয়ার্ড নামে এক ব্যক্তি যিনি বদাউনের ম্যাজিস্ট্রেট এবং কালেক্টর ছিলেন তাঁর বক্তব্যেও এর সমর্থন পাওয়া যায়। জমিদার তালুকদার এবং বেশি জমিনের মালিকদের দুর্দশার অন্ত নেই। অন্যদিকে কোম্পানীর শাসনের সুযোগ নিয়ে নতুন গজানো বেনিয়া সম্প্রদায় ফেঁপে ফুলে উঠতে লাগলোলা। সামন্ত এবং দেশীয় রাজন্যবর্গ পেনশনভোগীতে পরিণত হলেন। সুতরাং বিপদের সময়ে সরকারি ব্যবস্থা অচল হয়ে পড়লে শান্তি এবং শৃঙ্খলা রক্ষা করার জন্য গ্রামাঞ্চলে কেউ সচেষ্ট হননি।