বেতনের পরিমাণ সেপাইদের মনস্তত্বে গভীর প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছে। তারা লক্ষ্য করলে অধিক মাইনেধারী ইউরোপীয় সৈন্যের সংখ্যা নিতান্তই অল্প। সেপাইদেরকে সাগরের পরপারের দেশে যুদ্ধ করতে পাঠালে তাদের খরচা যে কম হয়, এ কথাও বেশ পরিষ্কারভাবে বুঝতে পারলো। সুতরাং তারা ধর্মের বিরুদ্ধে ব্রিটিশের বর্তমান গুজবকে সত্য বলে বিশ্বাস করলো।
সংখ্যালঘিষ্ঠ শ্বেতকায় এবং দেশীয় সেপাইদের মধ্যে আগে যে ভালো সম্পর্ক ছিলো, এখন তা অতীতের ব্যাপারে পরিণত হয়েছে। সীতারাম আপন জবানীতে যা বলেছেন, আমি সবসময় ইংরেজ সেপাইদের সঙ্গে ভালো সম্পর্ক রক্ষা করতাম। আগে তারা আমাদেরকে অপরিমিত স্নেহ সহানুভূতি দেখাতেন। আমরা কি তাদের সমস্ত কঠিন কাজগুলো করি না? প্রখর উত্তাপ মাথায় নিয়ে আমরা তাঁদের পাহারা দিয়েছি। তাঁদের বাসার সামনে প্রহরীগিরি করেছি, আমাদের খাদ্যদ্রব্যের অংশ দিয়েছি। বর্তমানের সৈন্যদের সকলেই ভিন্ন ধরনের মানুষ। আগেকার সাহেবদের মতো দীর্ঘকায় এবং সুদর্শন নন। গালাগালি ছাড়া আমাদের ভাষায় একটা কথাও বলতে পারবেন না। বস্তুত:, একজন শ্বেতকায় সৈনিক রেগে গেলে মুখ দিয়ে গালাগালি ছাড়া কিছু বের হতো না। সীতারামের মতে আগেকার দিনেও ইউরোপীয়ান সার্জেন্টরা দেশীয় সেপাই বা এ্যডজুট্যান্টের নামে হাজার রকম নালিশ করতেন। তার ফলে সেপাইদের কঠোর শাস্তি ভোগ করতে হতো না।
উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশে বসবাসকারী একজন ইংরেজ ভদ্রলোকের মতে, কমিশন প্রাপ্ত অফিসারদের এবং সেপাইদের মধ্যে সৌহার্দমূলক সম্বন্ধ ছিলো না। একে অন্যের কাছে ছিলো সম্পূর্ণ অচেনা। সেপাইদেরকে তারা মানবেতর জীব বলে মনে করতেন। বিশ্রী গালাগাল দিতেন, শূয়র ছাড়া ডাকতেন না। সম্মানীয় দেশীয় সেপাই বিশেষ করে মুসলমানেরা তা ভয়ংকর অপমানজনক মনে করতো। বুড়ো অফিসারেরা অপেক্ষাকৃত শান্ত ছিলেন; কিন্তু তরুণ অফিসারেরা তাতে বেশ মজা পেতেন। সেপাইদের সঙ্গে মানবেতর জীবের মতো আচরণ করাকে তারা খুবই প্রশংসনীয় কাজ মনে করতেন। ইউরোপীয় সাধারণ সৈন্যটিও সেপাইদের যে মানুষের সম্মান দিতো না, এ কথা বাঙালি পল্টনে লেফটেন্যান্ট কর্ণেল উইলিয়াম হান্টার সাহেবও দ্ব্যর্থহীন ভাষায় স্বীকার করেছেন।
শুধু সামরিক শক্তির উপর নির্ভর করে একটি বিদেশী সরকার চলতে পারে না। শাসকদেরকে শ্রদ্ধাও আকর্ষণ করতে হয়। সেপাইরা যদি অফিসারদের উপর বিশ্বাস হারিয়ে ফেলে তা হলে সেনাবাহিনীর শৃঙ্খলা নষ্ট হবে, তা একরকম অবশ্যম্ভাবী। আগে অফিসারেরা তাঁদের অধীনস্থ সেপাইদের ছিলেন সহায়। তাঁরা ব্যক্তিগতভাবে সেপাইদের ভালোমন্দ দেখাশোনা করতেন। যখন প্রয়োজন তারা নিঃসংকোচে গিয়ে অফিসারদের সঙ্গে দেখা করতে পারতো। সীতারাম বলেছেন, আগেকার দিনে সাহেবরা নাচের অনুষ্ঠান করতেন রেজিমেন্টে। আগ্রহ সহকারে খেলাধুলা দেখতে আসতেন। শিকারে যাওয়ার সময় সমস্ত সেপাইদের নিয়ে যেতেন। পরবর্তীকালের সাহেবরা যে আগেকার সাহেবদের মতো নন তাঁদের মর্জি-মেজাজ আলাদা সে কথা সীতারাম এবং হেদায়েত আলী দু’জনেই উল্লেখ করেছেন। হেদায়েত আলী বলেছেন, ‘কোনো সেপাই সাহেবদের বাঙলোতে তাদের সঙ্গে দেখা করতে গেলে তারা ভয়ানক চটে যেতেন। পাদরীরা সাহেবদের উপর প্রভাব বিস্তার করাতেই সাহেবরা সেপাইদের চাইতে দূরে সরে গেছে বলে সীতারামের ধারণা। হেদায়েত আলী সাহেবদের এই ঔদাসীন্যকেই সিপাহী বিদ্রোহের কারণ বলে উল্লেখ করেছেন।
আবার অফিসার এবং সেপাইদের ঘনিষ্ঠতা বেশি হলে শৃঙ্খলার উন্নয়ন সম্ভব নয়। একজন দায়িত্বহীন অফিসার অধীনস্থ সেপাইদের সামনে নিজের অভাব অভিযোগের কথা বলে ফেলে অতি সহজে সরকারের মর্যাদাকে সেপাইদের চোখে অবনমিত করতে পারে। লর্ড উইলিয়াম বেন্টিংকের অর্থনৈতিক সংস্কারের ফলে ইউরোপীয় অফিসারবৃন্দের মধ্যে মহা-অসন্তোষের সৃষ্টি হয়। তারা খোলাখুলি ইউরোপীয় এবং ভারতীয় সৈন্যদের সামনে বিদ্রোহের আলাপ করতো। এ বিষয়ে সীতারাম কিঞ্চিৎ আলোকপাত করেছেন। ভারতে যে নতুন লাট সাহেব এসেছেন, অফিসারেরা তাকে মোটেই পছন্দ করে না। তিনি তাদের মাইনে কমিয়ে দিয়েছেন। অফিসারেরা তো বিদ্রোহ করে করে অবস্থা। তারা ঘরে ঘরে অনেক সভা করলো, তাদের মন খারাপ হয়ে গেলো। অনেকে সরকারের অধীনে চাকুরি করবে না বলাবলি করতে লাগলো। কোম্পানী বাহাদুর এই লাট সাহেবকে টাকা বাঁচাবার জন্য পাঠিয়েছেন, কারণ যুদ্ধে অনেক টাকা খরচ হয়ে গেছে। তারা বলতে লাগলেন, তাঁরা গরীব হয়ে পড়বে। কিন্তু একথা কে বিশ্বাস করে? কোম্পানী বাহাদুরের আবার টাকার অভাব কিসের? আমি এক রেজিমেন্টের লোকদের বলতে শুনেছি কলকাতা গিয়ে লাটসাহেবকে তাদের হক্তের দাবি মানতে বাধ্য করার জন্য তাদের সঙ্গে যেতে রাজী আছে কিনা। আমাকেও বলা হলো স্বদেশীয় অফিসারদের বাট্টার দাবির বিরুদ্ধে ইউরোপীয় অফিসারেরা কিছুই বলবে না। এ সময়ে সমস্ত অফিসারেরা লাট সাহেবের উপর ভয়ংকরভাবে ক্ষিপ্ত হয়ে উঠলো এবং সরকারের বিরুদ্ধে অনেক কথাই বললো। তারা লাট সাহেবকেই দোষারোপ করলেন সবচেয়ে বেশি, তিনি নাকি কোম্পানীর খোশামোদ করতে চান। ১৮৪৩ সালে এবং ১৮৪৯ সালে সশস্ত্র– অভ্যুত্থান করে দাবি আদায় করার পেছনেও একই বোধ সেপাইদের মধ্যে সক্রিয় ছিলো। ইউরোপীয় অফিসারদের তাঁদের লোকজনের ভরণপোষণের কারণে, বেশি মাইনের জন্য বিদ্রোহ করতে যদি নৈতিকভাবে না বাধে-তাহলে দেশীয় সেপাইদের ধর্মের সমর্থনে বিদ্রোহ করতে বাধবে কেনো?