একজন সামরিক অফিসার যিনি পঁচিশ বছর চাকুরির পর অবসর গ্রহণ করেছেন এবং বাঙালি পল্টনের সেপাইদের ভালোমতে চেনেন বলে দাবি করেছেন তার মতে সরকারের অন্যায় বা প্রতিশ্রুতি ভঙ্গের জন্যই সংঘটিত হয়েছে প্রতিটি বিদ্রোহ। উদাহরণ স্বরূপ জাভার কথা উল্লেখ করা যেতে পারে। সেখানে যখন বিদ্রোহ দেখা দিলো সেপাইরা স্বেচ্ছায় কালাপানি পেরিয়ে বিদ্রোহ দমন করতে রাজি হলো। কিন্তু একটি শর্ত, কিছুকাল পরে তাদের আবার ফিরে আসতে দেয়া হবে। কর্তৃপক্ষ প্রতিশ্রুতি রক্ষা করতে না পারায় গোলমাল দেখা দিলো। বেলুড় বিদ্রোহ, ব্যারাকপুর বিদ্রোহ এ সবের মূল কারণ হলো ধর্মীয় আচারের প্রতি অশ্রদ্ধা। সেপাইদের সুযোগ সুবিধা অবহেলা করা হয়েছিলো। নিম্নস্তরে কর্তৃপক্ষ যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন তা এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে অথবা পূরণে সরাসরি অস্বীকৃতি জ্ঞাপন করেছে। সেপাইরা ধরে নিলো তাদের ন্যায্য প্রাপ্য থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে। তারা সরকারের সর্বোচ্চ পরিষদ এবং তাদের অধীনস্থ কর্মচারিদের কথার মধ্যে যে কোনো প্রভেদ আছে তা ধরতে পারেনি। তার ফলে তারা উভয়ের ওপর বিশ্বাস হারিয়ে ফেললো। এ বিশ্বাসহীনতা তাদের নৈতিকতার উপর ক্ষতিকর প্রভাব বিস্তার করলো।
১৮৩৩ এবং ১৮৩৪ সালে যে গোলযোগ মাদ্রাজ এবং বাঙালি পল্টনের মধ্যে দেখা দেয় সরকারের প্রকৃত এবং আরোপিত প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করাই হলো তার কারণ। তার ফলে সেপাইদের চোখে সরকারের মর্যাদা রইলো না। সীমিত দৃষ্টিভঙ্গীর সেপাইরা বিদেশে যেতে স্বভাবত:ই অনিচ্ছুক ছিলো। অপরিচিত পরিবেশে গেলে তাদের যে কষ্টের সম্মুখীন হতে হয় তার জন্য অর্থ আদায় করতে চাইতো। তাদের দৃষ্টিতে ভারতবর্ষ এক দেশ নয়। পাঞ্জাব কিংবা সিন্ধু প্রদেশে যুদ্ধ করা ও বিদেশে যুদ্ধ করা একই কথা। প্রথম আফগান যুদ্ধের সময় সিন্ধু নদ অতিক্রম করলে জেনারেল পোলোক সেপাইদের একটা আলাদা বাট্টা দান করেছিলেন। এ দৃষ্টান্তের উল্লেখ করে যতোবার সিন্ধু নদ অতিক্রম করতো প্রতিবারই সেপাইরা আলাদা অর্থ দাবি করতো। ১৮৪৩ সালে সিন্ধু প্রদেশ ভারতের সঙ্গে সংযুক্ত হলো এবং ভারতবর্ষের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ হয়ে দাঁড়ালো। সাধারণ ছাউনি থেকে যতো দূরে হোক
কেন, কোনো একটি ভারতীয় প্রদেশে যুদ্ধ করার সময়ে তারা আলাদা ক্ষতিপূরণ দাবি করতে পারে না। কর্তৃপক্ষের এ যুক্তি সেপাইরা মানবে কেনো? সিন্ধুনদ এখনো আছে। ১৮৪২ সালে সিন্ধুর জীবন যাত্রা যে রকম কঠোর ছিলো, এখনো সে রকম আছে। সুতরাং ১৮৪৪ সালে তারা কেননা ক্ষতিপূরণ পাবে না! সিন্ধু নদ অতিক্রমণ বাট্টা না পেলে ৩৪নং বাঙালি রেজিমেন্ট সিন্ধুনদ অতিক্রম করতে অস্বীকার করলো। ৭নং বাঙালি অশ্বারোহী বাহিনীও একই ধূয়া ধরলো। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে তাদের একগুঁয়েমীর শায়েস্তা করা হলো না। গুজব রটলো, ইউরোপীয়ানরা সেপাইদের দাবির প্রতি সহানুভূতিসম্পন্ন, কারণ তারা ন্যায্য পাওনার চেয়ে বেশি কিছু দাবী করছে না। কিছু সময়ের জন্য বিদ্রোহীদেরকে আলাদা থাকতে হলো।
তারপরে ৪র্থ এবং ৬৯নং রেজিমেন্ট ৩৪নং বাঙালি রেজিমেন্টের অনুসরণে সিন্ধু নদ অতিক্রমণ বাট্টা না পাওয়া পর্যন্ত সিন্ধু নদ পার হতে রাজী হলো না। ৬৪নং রেজিমেন্টও একই দাবি তুললো এবং সর্বাধিনায়ক তাদের দাবি সঙ্গত মনে করলেন। সিন্ধু প্রদেশে যে সকল সেপাই যুদ্ধ করবার জন্য যায় তাদের নদ অতিক্রমণ বাট্টা ছাড়া অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা এখনো দেয়া হয়ে থাকে। যে সকল সেপাই সিন্ধুতে চাকুরি করার সময় মারা যায় তাদের উত্তরাধিকারীদের পারিবারিক পেনশন দেয়া, হয়। অবশ্য তার জন্য সেপাইর ভালো আচরণ থাকতে হবে। কিন্তু তাদের সর্বাধিনায়ক মোসৃলি ভরসা দিলেন পোলোক যে বাট্টা দিয়েছিলেন, তারা তারও প্রত্যাশা করতে পারে। প্রধান সেনাপতির কথামতো তারা শিকারপুরে পৌঁছে প্রতিশ্রুত বর্ধিত অর্থ ছাড়া তাদের মাইনে নিতে অস্বীকৃতি জ্ঞাপন করলো। তাদের সাথে যে প্রতারণা করা হয়েছে তার প্রতিবাদে তারা সোচ্চার হয়ে উঠলো এবং সমস্ত ব্যাপারটা এক অপ্রীতিকর রূপ পরিগ্রহ করছিলো। কিন্তু জর্জ হান্টার অত্যন্ত সাহসিকতার সঙ্গে বিষয়টির মোকাবেলা করলেন। তিনি তাদেরকে শুক্কুরে গিয়ে বাট্টাসহ তাদের মাইনে নেয়ার জন্য প্রলুব্ধ করলেন। সেখানে অন্যান্য ইউরোপীয় অফিসারদের উপস্থিতিতে সেপাইদের শান্ত করা হলো। কারো সম্মানের হানি করা হলো না। কিন্তু যে ক্ষতি সাধিত হলো, তার কোনো তুলনা নেই। সেপাইরা দেখলো, উধ্বতন অফিসারদের তারা আর বিশ্বাস করতে পারছে না। ১৮৫৭ সালের সঙ্কটকালে অফিসারদের গ্যারান্টিতে যে তারা আর বিশ্বাস করতে পারেনি তাতে আশ্চর্য হওয়ার কিই-বা আছে।
মাদ্রাজী সেনাবাহিনীর অবস্থা আরো ভয়াবহ। বাঙালি রেজিমেন্টের সেপাইদের বালবাচ্চা, স্ত্রী সকলেই গ্রামের অধিবাসী। কিন্তু মাদ্রাজ রেজিমেন্টের সেপাইদের স্ত্রী পুত্র তাদের সঙ্গে সঙ্গে থাকে এবং একই সঙ্গে এগুতে হয়। এক অর্থে দূরদেশে গমন তাদের পক্ষে আরো অসম্ভব। ৬নং মাদ্রাজ অশ্বারোহী বাহিনীকে কাম্পতি থেকে জব্বলপুর যাত্রার আদেশ দেয়া হলো। জব্বলপুর মাদ্রাজের বাইরে। তাদেরকে জানানো হয়েছিলো, সেখানে অল্পকাল অপেক্ষা করার পরে তাদেরকে আবার প্রেসিডেন্সিতে ফিরে আসতে দেয়া হবে। পরে তারা জানতে পেলো, তাদেরকে শুধুমাত্র জব্বলপুরে বদলী করা হয়নি, স্থায়ীভাবে নশ’ মাইল দূরবর্তী আড়কোটেও তাদের চাকুরি করতে হবে। সবচেয়ে দুঃখের বিষয় নিতান্ত অল্প ভাতাতেই তাদের চাকুরি করতে হবে। স্বভাবতঃই তাদের অসন্তোষ আর রাখাঢাকা রইলো না। এ জন্য রেজিমেন্টের অধিনায়ক মেজর ফিল্ডকে দোষারোপ করতে লাগলো। তারা ডিউটি থেকে ফিরে এলো। অধিনায়কের বিরুদ্ধে তারা প্রচণ্ড বিক্ষোভে মেতে উঠলো। কর্তৃপক্ষের প্রতিশ্রুতি ভঙ্গের আরেকটি তাজা দৃষ্টান্ত হলো জব্বলপুরের ঘটনা।