নিম্নবর্গের ইতিহাসের অপর আলোচ্য বিষয় হল ঐতিহাসিক উত্তরণের সমস্যা। এর অন্তত দুটি দিক আছে। একটি হল, উচ্চবর্গ/নিম্নবর্গের রাজনৈতিক সংগ্রামের ফলস্বরূপ সমাজকাঠামোয় মৌলিক পরিবর্তনের সম্ভাবনা কতদূর? অন্যটি হল, নিম্নবর্গের চেতনার পৃথক ও স্বতন্ত্র রূপটিতে পরিবর্তনের সম্ভাবনা আছে কি? পরিবর্তন ঘটলে তা কীভাবে ঘটে? প্রথম প্রশ্নটির বলা বাহুল্য কোনও সরল কিংবা সাধারণভাবে প্রযোজ্য উত্তর নেই। কারণ এই সম্ভাবনাগুলো একান্তই নির্ভর করে বিশেষ ঐতিহাসিক দ্বন্দ্বের অসম বিকাশের ফলে সৃষ্ট বিরোধগুলির ক্ষেত্রে বিভিন্ন শ্রেণী, গোষ্ঠী বা জনসমষ্টির রাজনৈতিক ভূমিকা ও পারস্পরিক শক্তির উপর। উত্তরণ-প্রক্রিয়ার কোনও সাধারণ নিয়ম এখনও পর্যন্ত আবিষ্কার করা যায়নি। তবে উচ্চবর্গ/নিম্নবর্গ বিশ্লেষণ পদ্ধতি যাঁরা অনুসরণ করেন, তাঁদের বিশ্বাস উত্তরণ-প্রক্রিয়ার কেন্দ্রস্থলে অবস্থিত শ্রেণীসংগ্রামের রাজনৈতিক প্রকাশ ও শ্রেণীচেতনার বৈপরীত্য গভীরভাবে অনুসন্ধান করলে এই সাধারণ নিয়মগুলি নির্ধারণ করা অপেক্ষাকৃত সহজ হবে। বিশেষ করে, শ্ৰেণীসম্পর্কের জটিল বিন্যাস এবং সমাজকাঠামোর বিভিন্ন স্তরে ও ভৌগোলিক ব্যাপ্তিতে শ্রেণীদ্বন্দ্বের অসম বিকাশকে আরও স্পষ্টভাবে বোধগম্য করে তোলা যাবে।
দ্বিতীয় প্রশ্নটিও সমস্যাকণ্টকিত। উচ্চবর্গের চেতনার স্বরূপ ও তার নিজস্ব বিবর্তনের ধারা ঐতিহাসিকদের কাছে অনেক বেশি সহজবোধ্য। নিম্নবর্গের চেতনার সন্ধান জানা যায় নানা জটিল বিশ্লেষণ ও ব্যাখ্যার মাধ্যমে। এই মুহূর্তে এই বিশ্লেষণপদ্ধতিগুলি যে অভিনব এবং অপেক্ষাকৃত অনির্দিষ্ট, তাতে কোনও সন্দেহ নেই। বিশেষ দেশ-কালের সীমানার মধ্যে এই বিশ্লেষণ নিম্নবর্গের চেতনার স্বরূপ উদ্ঘাটন করতে সাহায্য করছে কি না, তা বিচার করার একমাত্র মানদণ্ড হল সমাজ পরিবর্তনের বৈপ্লবিক রাজনীতির মানদণ্ড। পুঁজিবাদী উৎপাদন-প্রক্রিয়া ও রাষ্ট্রের অধীন যে আধুনিক সমাজব্যবস্থা, তার ঐতিহাসিক উত্তরণের ক্ষেত্রে কৃষকচেতনার একক, এমন কি প্রধান ভূমিকাও থাকা সম্ভব নয়। বুর্জোয়া চেতনার সমগ্রতা, তার ঐতিহাসিক নিশ্চয়তা, ক্ষমতা ব্যবহারের নানা জটিল প্রক্রিয়ার সঙ্গে পাল্লা দিতে পারে, এমন কোনও শ্ৰেণীচেতনার নেতৃত্বে বৈপ্লবিক রাজনীতিতে অংশগ্রহণ করা ছাড়া কৃষকশ্রেণীর ঐতিহাসিক পরাধীনতার অবসান সম্ভব নয়। মার্কসবাদের আদিযুগ থেকেই এ সত্য সর্বজনস্বীকৃত। কিন্তু পুঁজিবাদী উৎপাদনের বিশ্বব্যাপী প্রসারের পরেও যে বহু দেশে এক বিশাল কৃষকশ্রেণী তার স্বতন্ত্র অস্তিত্ব দীর্ঘদিন বজায় রেখে চলবে, এমন সম্ভাবনার কথা উনিশ শতকের ইউরোপীয় মার্কসবাদীরা ভাবেননি। তখন মনে করা হত, কৃষকশ্রেণীর অবলুপ্তি পুঁজিবাদী উৎপাদনের অবশ্যম্ভাবী পরিণতি—নির্মম, রক্তক্ষয়ী, কিন্তু অনিবার্য। অথচ ১৯১৭-র রুশ বিপ্লব থেকেই দেখা গেছে, তথাকথিত অনুন্নত দেশগুলিতে ঐতিহাসিক উত্তরণ সম্ভব হয়েছে ব্যাপক কৃষক জনসমষ্টির প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণের মাধ্যমে। এক বৃহত্তর সর্বহারা শ্রমিকশ্রেণীর অঙ্গীভূত হয়ে নয়, তাদের জীবিকা, জীবনধারণ ও চেতনার আপেক্ষিক স্বাতন্ত্র্য বজায় রেখে শ্রমিকশ্রেণীর সঙ্গে বৈপ্লবিক ঐক্যের মধ্য দিয়ে।
সুতরাং ভারতবর্ষের মতো কৃষিজীবীবহুল দেশে কৃষকচেতনার পরিবর্তনের সমস্যা কোনও ঐতিহাসিক অনিবার্যতার ধারণা দিয়ে সমাধান করা যাবে না। আধুনিক পুঁজিবাদের ক্ষমতার বিরুদ্ধে লড়তে সক্ষম এমন শ্রেণীচেতনার সঙ্গে বৈপ্লবিক ঐক্যের সম্ভাবনার মধ্যেই এর সমাধান খুঁজে পাওয়া যাবে। এইজন্যই আন্তোনিও গ্রামশি বলেছিলেন, সাবলটার্ন শ্রেণীর জীবনযাত্রা, আচার-আচরণ, ভাবাদর্শ গভীরভাবে অনুসন্ধান করা প্রয়োজন। আজকের ভারতবর্ষের ক্ষেত্রেও সেই কারণে বৈপ্লবিক নেতৃত্ব তথা বুদ্ধিজীবীদের পক্ষে প্রয়োজন হয়ে পড়েছে, উচ্চবর্গ/নিম্নবর্গ দ্বন্দ্বের জটিল বিন্যাস ও অসমতা, বিভিন্ন জনগোষ্ঠী ও অঞ্চলে সেই দ্বন্দ্বের নানা ধরনের বহিঃপ্রকাশ, এবং এই অসমতার মধ্যে বৈপ্লবিক ঐক্যের সন্ধান করা।
৩
১৯৭০-এর দশকে ভারতের মার্কসবাদী রাজনীতিক-বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে যে উত্তপ্ত বাদানুবাদ ঘটে যায়, ‘সাবলটার্ন স্টাডিজ’-এর শিকড় খুঁজে পাওয়া যাবে সেই অসম্পূর্ণ বিতর্কে। ওপরে উদ্ধৃত প্রবন্ধটিতেও তার চিহ্ন দেখা যাচ্ছে। দুটি বিষয়কে কেন্দ্র করে বিতর্ক জমে উঠেছিল ওই সময়। একটিতে অংশ নেন প্রধানত অর্থনীতিবিদেরা, যাঁদের আলোচ্য ছিল ভারতবর্ষের কৃষি-অর্থনীতিতে পুঁজিবাদী উৎপাদনরীতির উদ্ভব। এক পক্ষের বক্তব্য ছিল, ঔপনিবেশিক আমলের শেষ পর্ব থেকেই ভারতের কৃষি-উৎপাদন ব্যবস্থায় এক আমূল পরিবর্তন ঘটে গিয়েছে। কৃষিপণ্যের বিশ্বব্যাপী বাজার এবং বড়মাপের সংগঠিত অর্থলগ্নী ব্যবস্থার সঙ্গে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে গিয়ে বড়-মাঝারি-ছোট সবরকম উৎপাদনই এখন পুঁজীবাদী উৎপাদন-রীতির নিয়ম মেনে চলতে শুরু করেছে। অন্য পক্ষ দেখাবার চেষ্টা করে যে কোনও কোনও এলাকায় সীমিত কিছু পরিবর্তন সত্ত্বেও ভারতের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে আধা-সামন্ততান্ত্রিক কৃষি-উৎপাদন ব্যবস্থা এখনো অটুট রয়েছে। বৃহত্তর বাজার বা লগ্নীব্যবস্থার সঙ্গে যুক্ত হয়েও প্রাক-ধনতান্ত্রিক সমাজের মৌলিক রূপান্তরের কোনও চিহ্ন দেখা যায়নি। অন্য বিতর্কটি হয় প্রধানত ঐতিহাসিকদের মধ্যে। সেখানে আলোচ্য ছিল উনিশ শতকের বাংলায় তথাকথিত নবজাগরণ। জাতীয়তাবাদী, এমন কি মার্কসবাদী ইতিহাসেও দীর্ঘদিন ধরে ‘নবজাগরণ’-এর মণীষীদের ‘প্রগতিশীল’ ভূমিকা একটা গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় অধিকার করে ছিল। সত্তর দশকে অশোক সেন, রণজিৎ গুহ, সুমিত সরকার ইত্যাদি ঐতিহাসিক প্রশ্ন তুললেন, রামমোহন-বিদ্যাসাগর প্রমুখ মণীষীদের ঐতিহাসিক ভূমিকা প্রগতিশীল কোন অর্থে? তাঁদের সংস্কার-চিন্তা তত ঔপনিবেশিক অর্থনীতি-রাজনীতির সীমানা ছাড়িয়ে এগোতে চেষ্টা করেনি। বস্তুত ব্রিটিশ শাসনের প্রগতিশীলতার ওপর আস্থা রেখেই তো তাঁদের সমাজ-সংস্কার প্রচেষ্টার শুরু, আর সেই শাসনক্ষমতার সীমাবদ্ধতাই তাঁদের সংস্কার-প্রচেষ্টার সীমা। ঔপনিবেশিক ভারতে ক্ষমতার বিন্যাস নিয়ে কোনও মৌলিক প্রশ্ন ‘নবজাগরণ’-এর নায়কেরা তোলেননি, বরং সেই ক্ষমতাবিন্যাসকে অবলম্বন করেই তাঁরা সামাজিক প্রগতি আনার চেষ্টা করেছেন। সে চেষ্টা ব্যর্থ হওয়া অনিবার্য ছিল।