স্বদেশ-এর সম্পাদক ১৯২১-এর এপ্রিলে লিখছেন, দেবী ভবানীর নামে ভিক্ষা অথবা ভোগ যেমন প্রচলিত, তেমনি গান্ধীর নামে মেয়েদের ভিক্ষা চাওয়া আর ভোগ দেওয়ার খবর এসেছে বিভিন্ন জায়গা থেকে। এমন কী ঢেঁকিশালে যখন সদ্য রবিশস্য তুলে আনা হয়েছে, মহিলারা আসতেন শস্যভিক্ষা চাইতে, যা লাগবে মহাত্মার ভোগে। ভোগ দেওয়ার যে আচার, তার সমসাময়িক তাৎপর্য সম্পূর্ণ পরিষ্কার নয়। তবে মনে হয় ভাগ্য ফেরানোর বিশ্বাস এর সঙ্গে জড়িত। কিন্তু এক্ষেত্রে লক্ষণীয় হল দেবী ভবানীর আরাধনাসংক্রান্ত আচারের বিস্তার; ঢেঁকিশালে ভিক্ষা চেয়ে কৃষকের মনে এমন এক নৈতিক দায়বোধ চারিয়ে দেওয়ার প্রয়াসও বটে, যে শস্য যখন প্রয়োজনের অতিরিক্ত আছে, তখন মহাত্মার নামে তা দান করা কর্তব্য। আরও লক্ষণীয়, যে গুড় তৈরি করে যে চাষি, তাকেও এমন দায়ে বদ্ধ করা হত। আখখোয়াড়ে গিয়ে গুড় ভিক্ষা চাওয়া প্রচলিত ছিল। আর সেই স্থান থেকে ভিখারিকে ফিরিয়ে দেওয়া নাকি অমার্জনীয় অপরাধ। ১৯২১-এর ১ মার্চ আজমগড় জেলায় নানুশাক গ্রামে এক আহীরের কাছে গুড় ভিক্ষা চাইতে গিয়েছিল একজন সাধু। আহীর সাধুকে ফিরিয়ে দেয়। গুজব যে আধ ঘণ্টার মধ্যে আহীর-এর গুড় আর সঙ্গে দুটি মহিষ আগুনে পুড়ে শেষ হয়ে যায়। স্বদেশ পত্রিকায় এ কাহিনীর যে বিবরণ পাই, তাতে গান্ধীর কোনও উল্লেখ নেই। কিন্তু লক্ষ্ণৌ-এর পায়নিয়র পত্রিকা অনুযায়ী, সাধুটি মহাত্মার নামেই ভিক্ষা চাইছিল। সত্যি হোক আর নাই হোক, গান্ধীর নাম যে এ ঘটনার সঙ্গে আরও পত্রিকাও জড়িয়েছিল, এটা খুবই সম্ভব।
স্থানীয় জাতীয়তাবাদী সাপ্তাহিকে এসব গুজবের প্রতিবেদন কি একটা ইঙ্গিত স্পষ্ট করে না যে কিছু গোষ্ঠী কায়েমি স্বার্থসিদ্ধির তাগিদে গুজবগুলো ছড়িয়েছিল? এ কথা সত্যি যে স্বদেশ-এ তা ছাপা হত তখনই, যখন পত্রিকা দপ্তরে কেউ লিখে পাঠাত তেমন কাহিনী। তবে তার অর্থ এই নয় যে, ছাপার অক্ষরে প্রকাশিত হওয়ার আগে এমন-সব গুজবের অস্তিত্ব কি প্রচলন ছিল না। জ্ঞানশক্তি-র মতো জাতীয়তাবাদবিরোধী স্থানীয় পত্রিকায় গুজবের প্রতিবেদনে সেই প্রচলনেরই প্রমাণ।
একথা অবশ্য সন্দেহাতীত যে স্বদেশ-এ প্রকাশ পেলে, তাদের প্রচলন বাড়ে, আরও বিশ্বাসযোগ্যও হয় তারা। ফরাসি বিপ্লবকালে গ্রামে আতঙ্কের বিশ্লেষণে ঐতিহাসিক লেকেব্র দেখিয়েছেন, গুজবকে ছাপার অক্ষরে প্রকাশ করে সাংবাদিকরা কীভাবে তাতে জুড়ে দিতেন নতুন জোর। তা সত্ত্বেও এটা পুরোপুরি মানা যায় না যে ছাপার অক্ষর গুজবের চেহারাকে খুব বেশি বদলে দেবে। গুজব এমনই এক মৌখিক ভাষা, যার স্রষ্টার নাগাল পাওয়া ভার। ছাপার অক্ষরে তার কার্যকারিতা বাড়ে। তবে গোরখপুরের মানুষ যে গল্পসমূহ মেনে নেয়, তার কারণ এই নয় যে স্থানীয় সংবাদপত্রে তাদের আস্থা অগাধ। কাহিনীগুলি তাদের বিশ্বাস, অলৌকিক নিয়ে তাদের ধারণা, তাদের নীতিবোধ, এসবের সঙ্গে একাকার হয়েছিল—গোরখপুরের মানুষের বিশ্বাসের মূল এটাই।
এমন সব গুজবের প্রচলনে স্থানীয় কংগ্রেস নেতাদের প্রতিক্রিয়া কী ছিল? জেলা কংগ্রেসের সভাপতি মৌলভী সুবহানুল্লাহ ১৯২২ সালে স্টেশন কোর্টে স্বীকার করেন যে, জনগণকে গুজবে বিশ্বাস থেকে বিরত রাখতে কংগ্রেস বা খিলাফৎ-এর পক্ষে কোনও প্রচেষ্টাই ছিল না। স্বদেশ পবিত্রতার দোহাই দিয়ে গুজব ছেপে চলে ‘ভক্তদের বিশ্বাস’ শিরোনামে। কিন্তু গুজবের প্রতি এই কাগজেরও ছিল দুটি ভূমিকা। একদিকে, তারা মাঝেমধ্যে নোট ছাপত অলৌকিক ঘটনাসমূহকে উড়িয়ে দিতে, এমন কি ব্যঙ্গকৌতুকও করত সেসব নিয়ে। অন্য দিকে, পায়নিয়র-এর আক্রমণের প্রতিবাদে নিজেদের তরফে গুজব ছাপার সাফাই গাইত। চাপে পড়ে, স্বদেশ-এর সম্পাদক কৃষকের মেনে নেওয়াকেও সাধুবাদ জানিয়েছেন। স্বদেশ-এর সম্পাদক, মহাত্মার প্রতি ভক্তির আদর্শ যিনি জেলায় ছড়িয়ে দিতে চেয়েছিলেন, তাঁর দ্বিধা ছিল না মহাত্মার প্রতাপ-বিষয়ে গুজব প্রকাশ করতে। তবে গুজব যখন বিপজ্জনক কোনও ধারণা অথবা কাজের প্ররোচক, যেমন জমিদারিপ্রথা বিলোপ, খাজনা কমানো, বাজারে ন্যায্যমূল্য প্রতিষ্ঠা, তখনই আবার স্বদেশ পত্রিকা গুজবের বিরোধী ভূমিকায় চলে যায়।
ঠিক যেমন গোরখপুরে নানান অলৌকিক ঘটনায় মহাত্মার নাম জড়িয়ে গেল, তেমনিভাবে জনসভা, পুস্তিকা ইত্যাদির সঙ্গে যুক্ত হয় তাঁর নাম। যুক্ত হয় মহাত্মার নাম স্বরাজ কথাটির সঙ্গে, একাধিক অর্থে যার ব্যবহার। চৌরিচৌরা দাঙ্গার পরিপ্রেক্ষিতে এলাহাবাদ কোর্টে জজেরা বললেন, এটা লক্ষণীয় যে গোরখপুরে কৃষকের মনে স্বরাজের সঙ্গে মিস্টার গান্ধীর নাম কীভাবে জড়িত। সাক্ষীরা বার বার বলে, এ হল গান্ধীর স্বরাজ অথবা মহাত্মার স্বরাজ, কৃষক যার পথ চেয়ে আছে। চৌরিচৌরা মামলার প্রধান আসামী লাল মহম্মদ কিছু উর্দু ঘোষণাপত্র বিক্রি করেছিল। তার মতে, সেগুলি গান্ধীর কাগজ; যখন গান্ধী চাইবেন, তখনই বের করবে বলে সে রেখেছিল। খিলাফৎ অর্থভাণ্ডারে দান করলে যে রসিদ পাওয়া যেত, তা অনেকটা এক টাকার মতো দেখতে। গোরখপুরের চাষিরা তাকে বলত গান্ধী-নোট। এসবের মধ্যে আমরা দেখি গান্ধীকে বিকল্প শক্তির স্রষ্টা ভাবতে জনসাধারণের বিশেষ প্রবণতা। স্থানীয় এক প্রামাণিক বিবৃতিতে পাওয়া যায়, ১৯২২-এর ৪ ফেব্রুয়ারি চৌরা থানায় ঐতিহাসিক সংঘর্ষের ঘণ্টা কয়েক আগে যেসব কৃষক-ভলান্টিয়ার দু মাইল দূরে ডুম্রীর দিকে যাচ্ছিল এক সভায় যোগ দিতে, তারা বলে, গান্ধী-মহাত্মার সভায় যাচ্ছে তারা, যা এনে দেবে গান্ধী-স্বরাজ। গোরখপুরে জেলা-কংগ্রেসের নেতৃত্ব ছাড়াই গান্ধী-স্বরাজ সম্পর্কে ধারণা তৈরি হয়েছিল। হাইকোর্ট জজরা লক্ষ করেছেন যে স্থানীয় কৃষক স্বরাজকে মিলিয়েছিল সেই আদর্শ স্বপ্নযুগে, যখন খাজনা নেওয়া হবে কম টাকায়, কি মাঠ বা ঢেঁকিশাল থেকে নেওয়া শস্যে, কৃষক জমি রাখতে পারবে নামমাত্র খাজনায়। আদালতে বিচারের সময় কংগ্রেস এবং খিলাফৎ-এর নেতারা বার বার বলেন যে এমন কোনও ধারণা গ্রামে তাঁরা প্রচার করেননি। বস্তুত এমন তথ্য আছে যে ১৯২১-এর মার্চ মাস থেকেই গোরখপুরের গ্রামে গ্রামে স্বরাজের আগমনবার্তা ঘোষিত হচ্ছিল। জমিদারদের অনুগামী জ্ঞানশক্তি পত্রিকা এসব ঘটনার প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করে; তাদের ভাষায়, এগুলি অশুভ ইঙ্গিত: