৩৫। বস্তি শহরে রঘুবীর কাসাউধন-এর বিধবা থাকেন। বিধবার পুত্রও বছর তিনেক হল মারা গেছে। তার স্বর্গত স্বামী দুটি আমগাছ পুঁতেছিলেন। একটিকে কিছুদিন আগে কেটে ফেলা হয়েছে, অন্যটিও গেছে শুকিয়ে। পনেরো দিন হল, শুকিয়ে যাওয়া গাছে হঠাৎ এসেছে নতুন পাল। বৃদ্ধা সেই বিধবা বলছেন, তিনি মহাত্মাজির কাছে মানত মেনেছিলেন—এই গাছই আমার স্বামীর একমাত্র স্মৃতিচিহ্ন, একে তুমি বাঁচিয়ে দাও। এই স্থানেও এখন বিরাট জনসমাগম হয়।
৩৬। স্বদেশ, ১৩ মার্চ ১৯২১: গত শনিবার গোরখপুর শহরের গোটা চার পাঁচ কুয়ো থেকে ধোঁয়া বেরতে শুরু করে। লোকের ধারণা হল, কূপের জলে আগুন লেগে গেছে, গোটা শহর ভেঙে পড়ল কূপগুলির কাছে। কিছু মানুষ একটি কূপ থেকে জল তুলল, সেই জলে ছিল ক্যাওড়াফুলের সুবাস। লোকের মনে হয়, এটা মহাত্মাজির প্রতাপের ফল। কুয়োটিতে কিছু টাকা প্রণামী দেওয়া হয়।
৩৭। স্বদেশ, ১০ এপ্রিল ১৯২১: কিছুদিন আগে গোরখপুর সিভিল কোর্টের কাছে এক গ্রামে মারাত্মক আগুন লাগে। গোটা গ্রামই প্রায় ধ্বংস হয়ে যায়। কাছাকাছি একটি নালা ছিল। কাদা আর জলের আশায় লোকে সেই নালার মধ্যে একটি কাঁচা কুয়ো খুঁড়তে থাকে। অনেক হাত খুঁড়বার পরেও কিন্তু জল মেলে না। লোকমুখে শোনা যায়, সেই সময় কেউ একজন মহাত্মার কাছে মানত করেছিল। হঠাৎ ফোয়ারার মতো জলে উপচে উঠল কুয়ো, ষোলো-সতেরো হাত কুয়োটি ভরে গেল জলে। আশপাশের গর্তগুলিও জলে পরিপূর্ণ হল। তার পর থেকে হাজার হাজার মানুষ সেখানে আসছে, ফুল বাতাসা টাকা দিচ্ছে, স্নান করছে, মুখ ধুচ্ছে সেই জলে, বাড়িতে নিয়ে যাচ্ছে সেই জল।
৩৮। ওই একই ঘটনা সম্বন্ধে জ্ঞানশক্তি লেখে: গোরখপুর শহরের বাইরে বুলন্দ্পুর গ্রামের দক্ষিণে একটি বিশাল গর্ত আছে, যার গভীরতা ২৩ ফুটের কম নয়। গোরখপুর শহরের জলসীমা ২১ ফুট। অনেক সময় ওই সীমার আগেই জল পাওয়া যায়। ওই অঞ্চলে কুয়ো থেকে জল তুলতে সাধারণত ১১ হাত দড়ি ব্যবহার করা হয়। যে কুয়ো থেকে ফোয়ারার মতো জল বেরিয়েছে, সেটি এই গর্তের মধ্যে। জল পাওয়া গেলে, তা কুয়োটিকে কানায় কানায় ভরিয়ে দেয়। সেখানে এখন মেলা হচ্ছে। এমন একটি বিশাল গর্তে যখন কুয়ো খোঁড়া হয়, এরকম ঘটনা তো স্বাভাবিক। এ ধরনের কুয়ো অনেক দেখা যায়, যা গর্তের ভিতরেই খোঁড়া আর কানায় কানায় ভর্তি। লোকে বিশেষ কুয়োটিকে এখন টাকা বাতাসা ফুল দিচ্ছে, বলছে এ নাকি গান্ধীর আশীর্বাদের নিদর্শন, কূপের নামকরণও হয়েছে গান্ধীর নামে।…স্বরাজের জন্য কি এমন জ্ঞানবুদ্ধি প্রয়োজন?
৩৯। মির্জাপুর বাজার, যেখানে জল আপনাআপনি বেরিয়ে এসেছে, ভক্তরা সেখানে দান করেছে ২৩ টাকা ৮ আনা ১২ পাই। শীছেদিলাল এই টাকা গোরখপুর স্বরাজ অর্থভাণ্ডারে পাঠাবার বন্দোবস্ত করেছেন।
৪০। বস্তি জেলার বিক্রমজিবাজারে এক কুয়োর জলে দুর্গন্ধ ছিল। দুজন মহাজন মহাত্মাজির নামে মানত করলেন। পরের সকালেই জল শুদ্ধ হয়ে যায়।
৪১। সোনাওরা গ্রামে মহামারী লেগেছে। লোক এসে থাকছে গ্রামের বাইরে এক কুঁড়েঘরে। কিন্তু সেখানকার কুয়ো এতই অগভীর যে ২৭ এপ্রিল একটা লোটাও তার জলে পুরোপুরি ডোবানো যাচ্ছিল না। দেখেশুনে এক মিশ্রজি গান্ধীজির নামে পাঁচ টাকা বিতরণ মনস্থ করলেন। এর পরই জল ক্রমশ বাড়তে থাকে, ২৮ তারিখ দুপুরের মধ্যে জল ওঠে পাঁচ হাত, তার পরদিন এগারো হাত।
কাহিনীগুলিতে আবার দেখছি, মহাত্মার ভাবরূপ লোকায়ত বিশ্বাস আর আচার-অনুষ্ঠানের কাঠামোতেই স্থান পাচ্ছে। আঞ্চলিক ধর্মীয় অনুষ্ঠানে মানত করার যে প্রথা, তাই গান্ধীর আরাধনার উপায় (২৮) থেকে (৩০) সংখ্যক আখ্যানে। (৩১) সংখ্যক গল্পে দেখলাম তারই এক ভিন্ন চেহারা। যেখানে ভগবানকে মানত করা ছাগলের জন্য ফল হল হিতে বিপরীত, যেমন উচ্চবর্ণ জমিদার-পরিবারে শারীরিক যন্ত্রণা, মানসিক অসুস্থতা। যার প্রায়শ্চিত্ত শুধুমাত্র ব্রাহ্মণভোজনে সীমাবদ্ধ থাকল না, ছাগলের মূল্য-সমান টাকা দান করতে হল জাতীয় বিদ্যালয়ের অর্থভাণ্ডারে।
কংগ্রেসবিরোধী জ্ঞানশক্তি পত্রিকা বৃক্ষ কি কূপের জীবনলাভকে (৩৩ নং, ৩৮ নং) যুক্তিপূর্ণ ব্যাখ্যা করল। অথচ রাজনৈতিক সচেতনতা সে বিন্যাস থেকে লুপ্ত। অঘটনের পার্থিব হেতুর দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করে এই ব্যাখ্যা। পানীয় জল সরবরাহ এবং সেচব্যবস্থার গুরুত্ব বুঝি কূপ-সংক্রান্ত আখ্যানগুলি (৩৬ সংখ্যক থেকে ৪১ সংখ্যক) থেকে। তবে, এ বিষয়ে আরও কিছু কথা বলা প্রয়োজন। প্রধান বিষয়বস্তু এক্ষেত্রে দুটি; প্রথমত, মহাজন কি উচ্চবর্ণের কোনও ব্যক্তির (সাধারণত জমিদার) পানীয় জল শুদ্ধ করার উদ্দেশ্যে মানত (আখ্যান ৪০ এবং ৪১ সংখ্যক); দ্বিতীয়ত, যেসব কূপে অলৌকিকভাবে জল এসেছে, সেখানে জনসাধারণের টাকা, ফুল, বাতাসা ইত্যাদি প্রণামী দেওয়া। দুটি বিষয়ই সহজে বোধগম্য, যদি মনে রাখি জমিদারেরই একমাত্র সামর্থ্য ছিল ইঁদারা নির্মাণের খরচ বইবার, আর গোরখপুরে ইঁদারা নির্মাণ ঘিরে গড়ে উঠেছিল আচারবহুল অনুষ্ঠান।
গোরখপুরে কূপ নির্মাণ নিয়ে পূজার মনোভাব তখন বর্তমান। তাই কুয়োর উদ্দেশে ফুল, বাতাসা, টাকা প্রণামী দেওয়া, বা সেই টাকা জাতীয় বিদ্যালয়ে দান করা, ১৯২১-এর গোড়ায় যা বিশেষ লক্ষণীয়, এই সব কিছুই উপস্থিত ধ্যান-ধারণাকে এক নতুন পরিপ্রেক্ষিতে বিস্তৃত করছে। গান্ধীর নামে মানত, ব্ৰত বা আরাধনা, কি তাঁর নাম করে মহিলাদের ভিক্ষা চাওয়া, ভোগবিতরণ, সবই সেই একই বিস্তারের অংশ।