গান্ধীর মন্ত্রের জনপ্রিয় ব্যাখ্যার দিকটা অন্য কয়েকটি আখ্যানে আরও প্রকট। এখানে কাকতালীয় আর ঘটনাপরম্পরা কার্যকারণের স্থানে প্রতিষ্ঠিত। গোরখপুরের শ্রোতৃবৃন্দকে গান্ধী মাছ-মাংস পরিত্যাগ করতে বলেননি। অথচ (২১), (২২) বা (২৪) সংখ্যক আখ্যানে গান্ধীর ভাবরূপ এবং প্রতাপ কাহিনীর মোড় ঘুরিয়ে দেয়, ঘটনাপরম্পরায় বৃহত্তর অর্থসমূহ প্রাধান্য পেয়ে যায়। ‘আমি মাছ-মাংস খাব, ধূমপান করব, গাঁজা-তাড়ি-মদ খাব, দেখি তোমার মহাত্মাজি কী করতে পারে’, গান্ধীর প্রতি এই অবজ্ঞাপূর্ণ বিরোধী মন্তব্যই গুজবের জন্ম আর প্রচলনে জরুরি। মিতাচারের পক্ষ আর বিপক্ষের সংলাপে গান্ধীর নাম কীভাবে ব্যবহৃত, সে ইঙ্গিত কাহিনীগুলিতে পরিষ্কার। গান্ধীর পথকে মানতে চাইল না যারা, তাদের সর্বনাশ অবশ্যম্ভাবী; সে সর্বনাশের সামাজিক তাৎপর্য এবং প্রায়শ্চিত্ত লোকায়ত বিশ্বাসকে অন্য এক চেতনার আস্বাদ দেয়; যা বোঝায়, স্থানীয় নিয়মে নির্ধারিত এসব রীতিনীতির বিরুদ্ধাচরণ ব্যবহারিক জীবনে কত অসম্ভব, কত অবাঞ্ছিত।
খাওয়াদাওয়ার শুদ্ধতা নিয়ে কেন এত উদ্বেগ? এই প্রশ্নের সম্পূর্ণ উত্তর জানবার মতো তথ্য আমাদের নেই। তবে কয়েকটি ইঙ্গিতপূর্ণ ব্যাখ্যা আছে। আগেই দেখেছি ১৯১০ সালে আচার-আচরণের শুদ্ধিকরণ নিয়ে গোরখপুরে একটি আন্দোলন গড়ে উঠেছিল, যার জের নিরামিষ ভক্ষণ পর্যন্ত গড়ায়। নিরামিষাশী হওয়ার কথা যে শুধু ধর্মপ্রচারকরা বলেছিলেন, তা নয়, নিম্নবর্ণের পঞ্চায়েত যেমন ধোবি, ভাঙ্গি, নাপিত, এরাও ঠিক করে, আহারের নিষেধাজ্ঞা না মানলে, জরিমানা দিতে হবে। ১৯২১-এর গোড়ায় শুদ্ধতার প্রতি এই আসক্তিকে দেখা যেতেই পারে গান্ধীবাদী আত্মশুদ্ধির (যথা মদ-গাঁজা বর্জন) বিস্তার হিসাবে। এই বিস্তারের পরিপ্রেক্ষিত এমনই যে, নিষেধাজ্ঞা মাছ-মাংস বর্জন পর্যন্ত অগ্রসর হতে পারে সহজেই। সঙ্গে সঙ্গে একে ভাবা যায় ধর্মভাব এবং নিম্নবর্ণের আত্মপ্রতিষ্ঠার প্রমাণ। উল্লেখযোগ্য যে, ১৯২১-এর জানুয়ারিতে উত্তর বস্তির পঞ্চায়েতরা বলে, নিষেধাজ্ঞা অমান্য করার যে একান্ন টাকা জরিমানা, তা দেওয়া হবে গৌশালার অর্থভাণ্ডারে।
(ঘ) ২৮। ভাগলপুরের দেবকলি মৌজার পণ্ডিত জীবনন্দন পাঠক লেখেন, ছ-মাস পূর্বে এক মুসলমানের পাত্র কূপে পড়ে গিয়েছিল। মহাত্মাজির কাছে মানত করার পরে পাত্রটি আপনিই আবার উঠে আসে।
২৯। আজমগড়ে নৈপুরা গ্রামে ডালকু আহীর-এর বহুদিনের হারানো বাছুর আবার তার খুঁটিতে ফিরে আসে, মহাত্মাজির উদ্দেশে মানত করার পর। ডালকু আহীর স্বরাজ অর্থভাণ্ডারে মানতের এক টাকা দান করেছিল।
৩০। বার্নিয়া জেলার এক ভদ্রলোক লেখেন, রুস্তমপুর মৌজায় গোয়ালাসাধুর কুঁড়েঘর থেকে নব্বই টাকা সমেত থলিটি উধাও হয়েছিল। মহাত্মার উদ্দেশে মানত করার পর টাকা-সমেত থলি ফিরে আসে।
৩১। দেওরিয়া তহশিল-এ সমগড় মৌজার এক নামী জমিদার ভগবতীজির কাছে মানতে ছাগবলি দেন। সেই মাংসের প্রসাদ অনেকেই নিয়েছিল। কিছুক্ষণের মধ্যে জমিদারতনয়ের হাত তার বুকের কাছে আটকে গেল, পাগল হয়ে গেল তার বউ। জমিদার তখন জাতীয় অর্থভাণ্ডারে সেই ছাগলের মূল্য দান করতে সম্মত হন। ব্রাহ্মণ-ভোজন করাবেন, এমন প্রতিজ্ঞাও নেন। ছেলে, ছেলের বউ, উভয়েরই স্বাভাবিকতা ফিরে এল।
৩২। গোরখপুর শহরে হুমায়ুনপুর মহল্লায় উকিলবাবু যুগলকিশোরের বাগানে দুটি গাছ মরে পড়ে গিয়েছিল। আবার তারা সজীবতা ফিরে পায়, উঠে দাঁড়ায় সোজা হয়ে। অনেকেই বলেন, মহাত্মাজির আশীর্বাদ এর মূলে। কারণ, যে লোকটি গাছ কেটেছিল, সে বলে মহাত্মাজির প্রতাপ যদি সাচ্চা হয়, গাছ দুটি আপনিই জীবন ফিরে পাবে। হাজার হাজার লোক রোজ আসে সেখানে, দেয় বাতাসা, টাকা, গয়না। লোকে বলে, এই প্রণামী স্বরাজ আশ্রম এবং তিলক স্বরাজ-অর্থভাণ্ডারে দেওয়া হবে।
৩৩। জ্ঞানশক্তি ১৯২১-এর এপ্রিলে লিখল, একটি শীর্ণকায় আবৃক্ষ ঝড়ে উৎপাটিত হয়েছিল। গাছটির শাখাপ্রশাখার ভারবহনের পক্ষে তার শিকড় ছিল দুর্বল। গাছটি পড়ে যাওয়ার পরেও, তার মুলের অংশবিশেষ মাটির তলায় ছিল। লোকে যখন জ্বালানির প্রয়োজনে পড়ে-যাওয়া গাছের ডালপালা কেটে নিয়ে যায়, অপেক্ষাকৃত লঘুভার গাছটি সেই শিকড়ের জোরে আবার সোজা হয়ে দাঁড়ায়। কিন্তু লোকের মুখে মুখে চালু হল, গাছটি আপনা থেকেই পুনর্জীবন পেয়েছে। লোকজন জড়ো হয় সেখানে, জায়গাটিতে যেন সর্বদাই মেলা। সকলেই দান করে বাতাসা, ফুল, টাকা। বলা হয় গান্ধীর প্রতাপেই নাকি তার জীবনলাভ। এই মেলা, লৌকিক বিশ্বাসের এই প্রকাশ শিক্ষিতের কাছে হাস্যকর।
৩৪। বস্তি জেলার এক সম্ভ্রান্ত ব্যক্তি স্বদেশ পত্রিকায় ঘটনাসমূহ লিখে পাঠিয়েছিলেন। চাকদেহী গ্রামে মহুয়া গাছের খুঁটি থেকে দুটি গাছ বেরিয়েছিল। কার্তিক মাসে খুঁটিটি পোঁতা হয়। তাতে বাঁধা থাকত এক পাঁড়েজির দুটি মহিষ। গুজব, যে এক চামার দেখেছিল, খুঁটি থেকে গাছটিকে বেরিয়ে আসতে। কিন্তু চামারের বউ সেটি টেনে একেবারে বের করে নেয়। ফলে চামারের উপর খানিকটা চোটপাট করে লোকজন। চামার প্রার্থনা করে, মহাত্মা, ‘তুমি যদি সত্যি সত্যি মহাত্মা হও, এই খুঁটিতে আর একটি গাছের জন্ম দাও’। তাই ঘটল। এখন প্রত্যহ সেই গাছ দেখতে বহু লোকের জমায়েত হয় জায়গাটিতে।