গৌতম ভদ্র-র বইটি বাদ দিলে এইসব লেখাপত্র সবই ছিল ইংরেজিতে। কিন্তু প্রথম খণ্ড সাবলটার্ন স্টাডিজ প্রকাশিত হওয়ার প্রায় সঙ্গে সঙ্গে বাংলা পত্রপত্রিকাতেও এই বিষয়ে আলোচনা শুরু হয়ে যায়। ১৯৮২-তে রণজিৎ গুহ কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগে বাংলায় দুটি বক্তৃতা করেন যা এক্ষণ পত্রিকায় ‘নিম্নবর্গের ইতিহাস’ শিরোনামে ছাপা হয়।১ হয়তো স্বাভাবিক কারণেই, বাংলা পত্রপত্রিকায় এ সময়কার বিতর্কে একটা প্রধান আলোচ্য বিষয় ছিল সাবলটার্ন স্টাডিজ-এর বিশ্লেষণপদ্ধতির সঙ্গে মার্কসীয় বিশ্লেষণপদ্ধতির সামঞ্জস্য অথবা অসঙ্গতি। ১৯৮৫-তে এক্ষণ পত্রিকায় ‘নিম্নবর্গ’ শব্দটির পারিভাষিক পরিচয় দিতে গিয়ে আমি এই প্রসঙ্গে খানিকটা বিশদ আলোচনা করি। প্রথম পর্যায়ের সাবলটার্ন স্টাডিজ-এর তাত্ত্বিক অবস্থান সম্বন্ধে একটা ধারণা এই আলোচনা থেকে পাওয়া যাবে, তাই সংক্ষিপ্ত প্রবন্ধটি নীচে উদ্ধৃত করলাম।২
২
Subaltern (নিম্নবর্গ): ইংরেজি ভাষায় শব্দটি বিশেষভাবে ব্যবহৃত হয় সামরিক সংগঠনের ক্ষেত্রে। ক্যাপ্টেনের অধস্তন অফিসারদের ‘সাবলটার্ন’বলা হয়। তবে শব্দটির সাধারণ অর্থ হল অধস্তন বা নিম্নস্থিত। আরিস্ততেলীয় ন্যায়শাস্ত্রে এর অর্থ এমন একটি প্রতিজ্ঞা যা অন্য কোনও প্রতিজ্ঞার অধীন, যা বিশিষ্ট, মূর্ত, সার্বিক নয়। সাধারণ অর্থে ইংরেজিতে এর সমার্থক শব্দ হল ‘সাবর্ডিনেট’।
মার্কসীয় আলোচনায় এই শব্দটির ব্যবহার পাওয়া যায় ইতালির কমিউনিস্ট নেতা ও দার্শনিক আন্তোনিও গ্রামশির (১৮৯১-১৯৩৭) বিখ্যাত কারাগারের নোটবই-তে। এই নোটবইতে বিভিন্ন শব্দের প্রয়োগ সম্পর্কে কিছু জটিলতা আছে। এটি রচিত হয়েছিল ১৯২৯ থেকে ১৯৩৫-এর মধ্যে, গ্রামশি যখন মুসোলিনির কারাগারে বন্দি। সেন্সরের শ্যেনদৃষ্টি এড়ানোর জন্য বহুক্ষেত্রে প্রচলিত মার্কসীয় পরিভাষা বর্জন করে অন্য শব্দ ব্যবহার করেন গ্রামশি। যেমন ‘মাকর্সবাদ’ কথাটা তিনি কোথাও ব্যবহার করেননি, বলেছেন ‘প্রাক্সিসের দর্শন’। মার্কসের নামও ব্যবহার করেননি, বলেছেন, ‘প্রাক্সিসের দর্শনের প্রতিষ্ঠাতা’। কিন্তু উল্লেখযোগ্য, এই ধরনের প্রতিশব্দ উদ্ভাবন করার মধ্য দিয়ে প্রচলিত মার্কসীয় ধারণাগুলি সম্পর্কে গ্রামশির নিজস্ব চিন্তা, তাদের তাৎপর্য সম্পর্কে তাঁর নিজস্ব বোধ, প্রায় অনিবার্যভাবেই প্রকাশ পেয়েছে। ‘মার্কসবাদ’-এর প্রতিশব্দ খুঁজতে গিয়ে তিনি যখন বেছে নেন ‘প্রাক্সিসের দর্শন’, তখন মার্কসবাদের তত্ত্বজগতের বিশেষ একটা দিক বেশি প্রাধান্য পেয়ে যায় তাঁর লেখায়। পরিভাষায় প্রচলিত অর্থের সঙ্গে যুক্ত হয় নতুন ব্যঞ্জনা। কারাবাসের পর্যায়ের রচনাগুলি পড়ার সময় আমরা এই রূপকসমৃদ্ধ ভাষার জায়গায় প্রচলিত পরিভাষাগুলি বসিয়ে নিয়ে পড়তে পারি নিশ্চয়। কিন্তু তাতে গ্রামশির চিন্তার জটিলতা, তার অভিনবত্ব, বহুলাংশেই হারিয়ে যাবে।
সাবলটার্ন (ইতালীয়তে সুবলতের্নো) শব্দটি গ্রামশি ব্যবহার করেছেন অন্তত দুটি অর্থে। একটি অর্থে এটি সরাসরিভাবে ‘প্রলেটারিয়াট’-এর প্রতিশব্দ। পুঁজিবাদী সমাজব্যবস্থায় ‘সাবলটার্ন শ্রেণী’ হল শ্রমিকশ্রেণী। সামাজিক ক্ষমতার এক বিশেষ ধরনের বিন্যাস ও প্রক্রিয়ার মধ্যে শ্রমিকশ্রেণী শোষিত ও শাসিত হয়। এই বিন্যাসে ‘সাবলটার্ন’ শ্রমিকশ্রেণী বিপরীত মেরুতে অবস্থিত ‘হেগেমনিক’ শ্রেণী অর্থাৎ পুঁজিমালিক, ‘বুর্জোয়াসি’। শ্রমিকশ্রেণী/বুর্জোয়াশ্রেণী, এই বিশেষ অর্থে সাবলটার্ন/ ‘হেগেমনিক’ শ্রেণীর সামাজিক সম্পর্কের বিষয়ে গ্রামশির বিশ্লেষণ আধুনিক মার্কসবাদী আলোচনায় এক বিশিষ্ট অবদান। এই বিশ্লেষণে গ্রামশি গুরুত্ব দিয়েছেন সেই ঐতিহাসিক প্রক্রিয়াটির উপর যার মাধ্যমে বুর্জোয়াশ্রেণী কেবল শাসনযন্ত্রে তার প্রভুত্বই প্রতিষ্ঠা করে না, সৃষ্টি করে এক সার্বিক সামাজিক কর্তৃত্ব বা ‘হেগেমনি’। কেবল রাষ্ট্রীয় শক্তিকে অবলম্বন করে এই সার্বিক কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হয় না। সংস্কৃতি ও ভাবাদর্শের জগতে এক আমূল পরিবর্তন ঘটিয়ে ‘হেগেমনিক’ বুর্জোয়াশ্রেণী তার শাসনের নৈতিক ভিত্তি হিসেবে ‘সাবলটার্ন’ শ্রমিকশ্রেণীর কাছ থেকে সামাজিক সম্মতিও আদায় করে নেয়। গ্রামশির বিশ্লেষণে তাই গুরুত্ব পায় রাষ্ট্রের সঙ্গে বৃহত্তর নাগরিক সমাজের সম্পর্ক, জাতি, জনগণ, বুর্জোয়াশ্রেণী ও অন্যান্য শাসকগোষ্ঠীর পারস্পরিক সম্পর্ক, জাতীয় জীবনের একচ্ছত্র প্রতিনিধি হিসেবে জাতীয় রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা, বুর্জোয়াশ্রেণীর সার্বিক কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠায় বুদ্ধিজীবীদের ভূমিকা, ইত্যাদি প্রশ্ন।
কিন্তু আরও সাধারণ অর্থেও ‘সাবলটার্ন’ কথাটি ব্যবহৃত হয়েছে গ্রামশির লেখায়। কেবল পুঁজিবাদী সমাজব্যবস্থায় নয়, শ্রেণীবিভক্ত সমাজের অন্যান্য ঐতিহাসিক পর্বেও ‘সাবলটার্ন’ শ্রেণীর কথা বলেছেন গ্রামশি। স্পষ্টতই এখানে ‘সাবলটার্ন-এর অর্থ শিল্পশ্রমিক শ্রেণী নয়। বরং যে-কোনও শ্রেণীবিভক্ত সমাজে ক্ষমতাবিন্যাসের কয়েকটি সাধারণ বৈশিষ্ট্যের কথা উঠছে এখানে। এই বিন্যাসকে গ্রামশি দেখেছেন একটি সামাজিক সম্পর্কের প্রক্রিয়ার মধ্যে, যার এক মেরুতে অবস্থিত প্রভুত্বের অধিকারী ‘ডমিন্যান্ট’ শ্রেণী অপর মেরুতে যারা অধীন সেই ‘সাবলটার্ন’ শ্রেণী। বহুক্ষেত্রেই অবশ্য গ্রামশি বিশেষ বিশেষ ঐতিহাসিক পরিস্থিতিতে কর্তত্ব, প্রভুত্ব, শাসন এই শব্দগুলিকে সমার্থক হিসেবে ব্যবহার করেছেন। ফলে কর্তৃত্বের অধিকার, প্রভুত্বের অধিকার, শাসনের অধিকার, এই ধারণাগুলির মধ্যে কোনও পার্থক্য আছে কি না, গ্রামশির আলোচনা থেকে তা বোঝা কষ্টকর হয়ে দাঁড়ায়।